যাকাত

যাকাত

ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে যাকাত অন্যতম।

ইসলামের নবী হযরত মোহাম্মদ যখন ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে মদিনায় গিয়ে ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা চালু করেন, তখন সে রাষ্ট্রে যাকাত ব্যবস্থা চালু হয়।

যাকাত ইসলামের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রোকন। ঈমানের পর সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য ইবাদত হল সালাত ও যাকাত। কুরআন মজীদে বহু স্থানে সালাত-যাকাতের আদেশ করা হয়েছে এবং আল্লাহর অনুগত বান্দাদের জন্য অশেষ ছওয়াব, রহমত ও মাগফিরাতের পাশাপাশি আত্মশুদ্ধিরও প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।

এক আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-

وَ اَقِیْمُوا الصَّلٰوةَ وَ اٰتُوا الزَّكٰوةَ ؕ وَ مَا تُقَدِّمُوْا لِاَنْفُسِكُمْ مِّنْ خَیْرٍ تَجِدُوْهُ عِنْدَ اللّٰهِ ؕ اِنَّ اللّٰهَ بِمَا تَعْمَلُوْنَ بَصِیْرٌ۝۱۱۰

‘তোমরা সালাত আদায় কর এবং যাকাত প্রদান কর। তোমরা যে উত্তম কাজ নিজেদের জন্য অগ্রে প্রেরণ করবে তা আল্লাহর নিকটে পাবে। নিশ্চয়ই তোমরা যা কর আল্লাহ তা দেখছেন। -সূরা বাকারা : ১১০

অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে-

وَ اَقِیْمُوا الصَّلٰوةَ وَ اٰتُوا الزَّكٰوةَ وَ اَطِیْعُوا الرَّسُوْلَ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُوْنَ۝۵۶

‘তোমরা সালাত আদায় কর, যাকাত দাও এবং রাসূলের আনুগত্য কর যাতে তোমরা অনুগ্রহভাজন হতে পার।’-সূরা নূর : ৫৬

সূরা নিসার ১৬২ নং আয়াতে আল্লাহ তাআলা তার বান্দাদের জন্য ‘আজরুন আযীম’-এর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে-

وَ الْمُقِیْمِیْنَ الصَّلٰوةَ وَ الْمُؤْتُوْنَ الزَّكٰوةَ وَ الْمُؤْمِنُوْنَ بِاللّٰهِ وَ الْیَوْمِ الْاٰخِرِ ؕ اُولٰٓىِٕكَ سَنُؤْتِیْهِمْ اَجْرًا عَظِیْمًا۠۝۱۶۲

‘এবং যারা সালাত আদায় করে, যাকাত দেয় এবং আল্লাহ ও পরকালে ঈমান রাখে আমি তাদেরকে মহাপুরস্কার দিব।’

অন্য আয়াতে যাকাতের গুরুত্বপূর্ণ সুফল বর্ণনা করে আল্লাহ তাআলা বলেন-

خُذْ مِنْ اَمْوَالِهِمْ صَدَقَةً تُطَهِّرُهُمْ وَ تُزَكِّیْهِمْ بِهَا وَصَلِّ عَلَیْهِمْ ؕ اِنَّ صَلٰوتَكَ سَكَنٌ لَّهُمْ ؕ وَ اللّٰهُ سَمِیْعٌ عَلِیْمٌ۝۱۰۳

‘তাদের সম্পদ থেকে সদকা গ্রহণ করুন, যার দ্বারা আপনি তাদেরকে পবিত্র করবেন এবং পরিশোধিত করবেন এবং আপনি তাদের জন্য দুআ করবেন। আপনার দুআ তো তাদের জন্য চিত্ত স্বস্তিকর। আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।’-সূরা তাওবা : ১০৩

ইসলাম ধর্মের পাঁচটি স্তম্ভের একটি হচ্ছে যাকাত। মূলত রমজান মাসেই সাধারণত মানুষ যাকাত প্রদান করে। কিন্তু যাকাত আসলে কতটা দিতে হয়, অর্থাৎ মানুষের স্থাবর সম্পত্তি না অস্থাবর সম্পত্তি, নাকি স্থাবর-অস্থাবর উভয়ের ওপরেই এটা ধার্য? কেবল এক বছরের বেশি সময় ধরে সঞ্চিত মূল্যবান জিনিসপত্রের ওপর, নাকি ব্যাংকে রাখা টাকা কিংবা সঞ্চয়পত্রের মূল্য নির্ধারণ করে যাকাত নির্ধারণ করতে হবে? নিম্নের আলোচনার মাধ্যমে জেনে নেয়া যাক।

 যাকাত আদায়ের গুরুত্ব ও উপকারিতা

আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “তোমরা সালাত আদায় কর এবং যাকাত প্রদান কর। তোমরা যে উত্তম কাজ নিজেদের জন্য অগ্রে প্রেরণ করবে তা আল্লাহর নিকটে পাবে। নিশ্চয়ই তোমরা যা কর আল্লাহ তা দেখছেন।” [সূরা বাকারা : ১১০]

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন, “তোমরা সালাত আদায় কর, যাকাত দাও এবং রাসূলের আনুগত্য কর যাতে তোমরা অনুগ্রহভাজন হতে পার।’’ [সূরা নূর : ৫৬]

হাদস শরীফে একে ইসলামের সেতুবন্ধন বলা হয়েছে। কারণ, এটি ধনী ও গরীবের মাঝে অর্থনৈতিক সেতুবন্ধন। মুসলিম সমাজ থেকে দরিদ্রতা দূরীকরণে এবং সমাজে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আনয়নে যাকাতের ভূমিকা অপরিসীম।

যাকাত আদায়ের গুরুত্ব

পবিত্র কুরআনের বিরাশিটি স্থানে সালাতের পর পরই যাকাতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এর কারণ প্রসঙ্গে আল্লামা তাবারী বলেন, “যে ব্যক্তি যাকাত আদায়ে সম্মত হবে না তার কোন সালাতই গ্রহণযোগ্য হবে না।” [ তাবারী-১৪/১৫৩]

যাকাত যে কত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, এ থেকে তা সহজে অনুমেয়। এটা দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, আমাদের সমাজে যাকাতের প্রচলন একেবারেই নগন্য। অথচ সালাত এবং যাকাত উভয়েই সমভাবে ফরয। একটি হচ্ছে আল্লাহর হক আর অপরটি বান্দার হক।

সূরা নিসার ১৬২ নং আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা তার বান্দাদের জন্য ‘আজরুন আযীম’-এর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে, ‘‘এবং যারা সালাত আদায় করে, যাকাত দেয় এবং আল্লাহ ও পরকালে ঈমান রাখে আমি তাদেরকে মহাপুরস্কার দিব।’’

অন্য আয়াতে যাকাতের গুরুত্বপূর্ণ সুফল বর্ণনা করে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘‘তাদের সম্পদ থেকে সদকা গ্রহণ করুন, যার দ্বারা আপনি তাদেরকে পবিত্র করবেন এবং পরিশোধিত করবেন এবং আপনি তাদের জন্য দু‘আ করবেন। আপনার দু‘আ তো তাদের জন্য চিত্ত স্বস্তিকর। আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।’’ [সূরা তাওবা : ১০৩]

এ কারণেই মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরাম যাকাতের প্রতি অধিক গুরুত্ব প্রদান করতেন।


হযরত আবু বকর রাদিআল্লাহু আনহু যাকাতের বিরূদ্ধচারণকারীদেরকে মুরতাদ হিসেবে গণ্য করেছিলেন। তাদের বিরূদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে বলেছিলেন, “আল্লাহর কসম! তারা যদি আমাকে ( যাকাতের) একটি উটের দড়িও প্রদান করতে অস্বীকার করে, যা তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রদান করত, আমি তাদের বিরূদ্ধে অস্ত্র ধারণ করবো, যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা তা আদায় করে দেয়।” [বুখারী ও মুসলিম]

ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী রাহ.-এর ভাষায়,‘যাকাত শরীয়তের এমন এক অকাট্য বিধান, যে সম্পর্কে দলীল-প্রমাণের আলোচনা নিষ্প্রোজন। যাকাত সংক্রান্ত কিছু কিছু মাসআলায় ইমামদের মধ্যে মতভিন্নতা থাকলেও মূল বিষয়ে অর্থাৎ যাকাত ফরয হওয়া সম্পর্কে কোনো মতভেদ নেই। যাকাতের ফরযিয়াতকে যে অস্বীকার করে সে ইসলাম থেকে খারিজ হয়ে যায়।’’ [ফাতহুল বারী ৩/৩০৯]

যাকাতের উপকারিতা

সম্পদের যাকাত আদায় করা মহান আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশ। আল্লাহর সন্তুষ্টির অন্যতম মাধ্যম। পার্থিব কোন উপকারিতা থাকুক আর না থাকুক, আল্লাহর নির্দেশ পালনে মুমিন সর্বদা বাধ্য। তবে আল্লাহর কোন নির্দেশ-ই পার্থিব উপকারিতা মুক্ত নয়। তেমনি যাকাতের মাঝেও রয়েছে ধর্মীয় অনুশাসন পালনের পাশাপাশি পার্থিব অনেক উপকারিতা। আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন, “আল্লাহ তা‘আলা সুদকে নিশ্চিহ্ন করেন এবং দান খয়রাতকে বর্ধিত করেন। আল্লাহ পছন্দ করেন না কোন অবিশ্বাসী পাপীকে।” [ সূরা বাকারা : ২৭৬ ]

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, কোন বান্দা যখন যাকাত আদায় করেন, তখন আল্লাহর আদেশে একজন ফিরিশতা তার জন্য এভাবে দু‘আ করতে থাকেন, হে আল্লাহ! আপনার পথে যে দান-সদাকা, যাকাত দেয়, তার সম্পদকে আপনি বৃদ্ধি করে দিন, আর যে ব্যক্তি সম্পদ ধরে রাখে (যাকাত দেয় না) তার সম্পদ আপনি ছিনিয়ে নেন।” [বুখারী]

মূলত যাকাত আদায় করলে বাহ্যিকভাবে সংখ্যায় মনে হয় যেন সম্পদ কমে যাচ্ছে। কিন্তু যাকাত আদায় করলে আল্লাহ তা‘আলা অবশিষ্ট সম্পদে প্রভূত বরকত দান করেন যা যাকাত না দিলে পাওয়া যেত না। আবার যাকাতের মধ্যে যে সম্পদটা খরচ হয়, আল্লাহ তা‘আলা ভিন্ন কোন উপায়ে সেই সম্পদ আবার ফিরিয়ে দেন।

কার ওপর যাকাত ফরয?

অনেকের মধ্যে ধারণা আছে, নিজের বা পরিবারের অধিকারে থাকা মূল্যবান দ্রব্যাদি যেমন স্বর্ণ-রৌপ্যালঙ্কার, দামী রত্ন বা এ ধরণের জিনিস থাকলেই কেবল যাকাত দিতে হবে।

হাতে গচ্ছিত নগদ অর্থ, শেয়ার সার্টিফিকেট, প্রাইজবণ্ড ও সার্টিফিকেটসমূহ, স্বর্ণ-রৌপ্য, মূল্যবান ধাতু ও সোনা-রুপার অলংকার, বাণিজ্যিক সম্পদ ও শিল্পজাত ব্যবসায় প্রতিশ্রুত লভ্যাংশ, উৎপাদিত কৃষিজাত ফসল, পশু সম্পদ—৪০টির ওপরে ছাগল বা ভেড়া, এবং ৩০টির ওপরে গরু-মহিষ ও অন্যান্য গবাদি পশু, খনিজ দ্রব্য, প্রভিডেন্ট ফাণ্ড – এসব কিছুর ওপরই যাকাত দিতে হবে, কিন্তু সেটা নিসাব অনুসারে।

নিসাব একটি ইসলামি শব্দ। এর মানে হচ্ছে দৈনন্দিন প্রয়োজন পূরণ ও নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রী বাদ দেয়ার পর সাড়ে বায়ান্ন তোলা পরিমাণ রূপা অথবা সাড়ে সাত তোলা পরিমাণ স্বর্ণ থাকলে অথবা এর সমমূল্যের ব্যবসায়িক পণ্যের মালিকানা থাকলে তাকে যাকাতের নিসাব বলে।

“নিসাবের মালিক হবার এক বছর পূর্তির পর যাকাত ফরয হয়।”

ইসলাম ধর্মের নিয়ম অনুযায়ী যেসব সম্পদের ওপর যাকাত দিতে হয়না এমন কিছু বিষয় নির্দিষ্ট করা আছে। এর মধ্যে রয়েছে,

  • বসবাসের জন্য নির্মিত ঘর;
  • ঘরের ব্যবহার্য আসবাবপত্র ও অন্যান্য দ্রব্য;
  • চাষাবাদে ব্যবহৃত পশু;
  • কাঁচা সবজি ও ফলের যাকাত নেই।

ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বিধানে যাকাত দিতে হবে না এমন জিনিসের তালিকায় রয়েছে,

  • জমি;
  • মিল-ফ্যাক্টরি;
  • ওয়্যার হাউজ;
  • গুদাম;
  • দোকান;
  • বাড়ী-ঘর;
  • পোশাক;
  • এক বছরের কম বয়েসী গবাদি পশু;
  • চলাচলের যন্ত্র ও গাড়ী;
  • সরকারি মালিকানাধীন নগদ অর্থ, স্বর্ণ-রৌপ্য এবং অন্যান্য সম্পদ।

যাকাত ফরয হওয়ার শর্তসমূহ

১.          নেসাব পরিমাণ মালের মালিক হওয়া। অর্থাৎ সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ, বা সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপা, কিংবা সমপরিমাণ মূল্যের নগদ টাকা বা ব্যবসার মালের মালিক হওয়া।

২.         মুসলমান হওয়া। কাফেরের উপর যাকাত ফরয নয়।

৩.         বালেগ হওয়া। নাবালেগের উপর যাকাত ফরয নয়।

৪.         জ্ঞানী ও বিবেক সম্পন্ন হওয়া। সর্বদা যে পাগল থাকে তার নেসাব পরিমাণ মাল থাকলেও তার উপর যাকাত ফরয নয়।

৫.         স্বাধীন বা মুক্ত হওয়া। দাস-দাসীর উপর যাকাত ফরয নয়।
৬.         মালের উপর পূর্ণ মালিকানা থাকা। অসম্পূর্ণ মালিকানার উপর যাকাত ফরয হয় না।

৭.         নেসাব পরিমাণ মাল নিত্য প্রয়োজনীয় সম্পদের অতিরিক্ত হওয়া।

৮.         নেসাব পরিমাণ মালের উপর এক বছর অতিবাহিত হওয়া।

কিভাবে যাকাতের পরিমাণ নির্ধারিত হবে?

“কোন ব্যক্তির পুরো সম্পত্তি যার অর্থ নির্ধারণ করা যায়, সেটি যদি এক বছরের বেশি সময় ধরে তার অধিকারে থাকে, তাহলে সেই সম্পদ ও সম্পত্তির ওপর যাকাত দিতে হবে। এই সম্পদের আড়াই শতাংশ হচ্ছে তার যাকাত।”

ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থ, শেয়ার মার্কেটে করা বিনিয়োগ যা এক বছরের বেশি সময় ধরে আমানতকৃত আছে এবং সেখান থেকে মুনাফা আসছে, এবং সঞ্চয়পত্র; এই সব ধরণের অর্থনৈতিক অধিকারের ওপর যাকাত দিতে হবে।

আর যাকাতের পরিমাণ হবে দৈনন্দিন প্রয়োজন পূরণের পর সাড়ে বায়ান্ন তোলা পরিমাণ রূপা অথবা সাড়ে সাত তোলা পরিমাণ স্বর্ণ থাকলে অথবা এর সমমূল্যের ব্যবসার মালিকানা থাকলে মোট সম্পদের আড়াই শতাংশ হারে যাকাত দিতে হবে।

ব্যবহৃত স্বর্ণের কি যাকাত দিতে হয়?

যাকাতের ক্ষেত্রে নিয়ম হলো, যেসব সম্পদ নিত্য ব্যবহার্য কাজে ব্যবহার হয়, সে সব সম্পদের যাকাত দিতে হবে না। যেমন কেউ বসবাসের জন্য বাড়ি কিংবা চলাফেরা করার জন্য গাড়ি কিনলে সেটার যাকাত দিতে হবে না। তবে এ ‍দুটি খাত খেকে আয় হলে বছরান্তে এর যাকাত দিতে হবে।

তবে স্বর্ণের বেলায় হিসাবটা একটু ভিন্নরকম হবে। স্বর্ণ নিত্য ব্যবহার্য হোক আর নাই হউক, দুই ধরনের স্বর্ণেরই যাকাত দেওয়া জরুরি। অনেকে মনে করেন, শুধু তোলা স্বর্ণেরই যাকাত দিতে হবে। কিন্তু ইসলামি শরিয়ত মতে, ব্যক্তির মালিকানায় যে ধরনের স্বর্ণই থাকুক না কেনো, যদি তা সাড়ে সাত ভরির বেশি এবং মালিকানার সময়কাল এক বছর হয়ে থাকে, তাহলে ওই স্বর্ণের বাজার মূল্যের হিসাব করে যাকাত আদায় করতে হবে। কত দিয়ে কিনেছিলেন তা বিবেচ্য বিয়য় নয়, বর্তমান বাজার মূল্য হিসেব করে মোট মূল্যের শতকরা আড়াই টাকা যাকাত দিতে হবে।

অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, স্বর্ণের মালিকানা স্ত্রী কিংবা মেয়ের থাকে। এক্ষেত্রে স্ত্রী এবং মেয়েকে নিজ উদ্যেগে স্বর্ণের যাকাত আদায় করতে হবে। রূপার ক্ষেত্রে যদি এর পরিমাণ সাড়ে বায়ান্না তোলা হয় তাহলে যাকাত আদায় করা ফরজ হবে।

বছরের মাঝখানে উপার্জিত সম্পদের যাকাত

নগদ অর্থের যাকাত ফরজ হয় দুইটি কারণে

১. নগদ অর্থ নিসাব পরিমাণ হওয়া।

২. নিসাব পরিমাণ অর্থের বছর পূর্তি হওয়া।

অতএব, সঞ্চিত অর্থ যদি নিসাবের চেয়ে কম হয় তাহলে যাকাত ফরজ হবে না। যদি সঞ্চিত অর্থ নিসাব পরিমাণ হয় এবং নিসাব পরিমাণ অর্থের এক বছর পূর্তি হয় অর্থাৎ পূর্ণাঙ্গ এক চন্দ্র বছর (হিজরী সাল) অতিবাহিত হয় তখন যাকাত ফরজ হবে। নিসাবের পরিমাণ হচ্ছে- ৮৫ গ্রাম স্বর্ণ ও ৫৯৫ গ্রাম রৌপ্য। মোট অর্থের ৪০ ভাগের এক ভাগ (২.৫%) যাকাত দেয়া ফরজ।

যদি কারো কাছে নিসাব পরিমাণ অর্থ থাকে; ধরা যাক সেটা ১০০০; আর বছর শেষে তার অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় ৫০০০ তে; তাহলে সে কিভাবে যাকাত আদায় করবে? এ ব্যাপারে বিশ্লেষণ প্রয়োজন:

(১)        এই অতিরিক্ত অর্থ যদি মূল অর্থের মাধ্যমে অর্জিত হয় যেমন- মূল এক হাজার যদি বিনিয়োগ করার মাধ্যমে লাভ হয় চার হাজার তাহলে বছর শেষে সর্বমোট অর্থের যাকাত আদায় করতে হবে। কেননা বিধি হচ্ছে- লাভ পুঁজির বিধানের অনুগত।

(২)        যদি এই অর্থ মূল অর্থের মাধ্যমে অর্জিত না হয়; অন্য কোন মাধ্যমে অর্জিত হয়ে থাকে যেমন- উত্তরাধিকার, উপঢৌকন, কোন কিছু বিক্রি ইত্যাদি তাহলে এ সম্পদের আলাদা বছর হিসাব করা হবে। যেদিন এই অতিরিক্ত সম্পদ মালিকানায় এসেছে সেদিন থেকে বছর গণনা শুরু হবে। আর যদি মূল এক হাজারের সাথে যাকাত আদায় করে দিতে চায় সেটাও করতে পারেন। সেক্ষেত্রে তিনি এ অতিরিক্ত অর্থের যাকাত ফরজ হওয়ার আগেই অগ্রিম আদায় করে দিলেন। এতেও কোন অসুবিধা নেই।

(৩)        কারো ক্ষেত্রে এই অতিরিক্ত অর্থ ক্রমান্বয়ে অর্জিত হয়ে থাকতে পারে। যেমন আপনি মাসিক বেতন থেকে কিছু কিছু সঞ্চয় করলেন। যেমন একমাসে ৫০০ সঞ্চয় করলেন, অন্য মাসে ১০০০ সঞ্চয় করলেন, এভাবে বছর শেষে ৪০০০ হল। তাহলে আপনার এই সুযোগ আছে যে, মূল এক হাজারের যাকাত আদায়ের সময় অতিরিক্ত অর্জিত অর্থের যাকাতও আদায় করে দিবেন। সেক্ষেত্রে আপনি অতিরিক্ত অর্জিত অর্থের যাকাত নির্দিষ্ট সময়ের আগেই আদায় করে দিলেন। আর ইচ্ছা করলে আপনি প্রত্যেকবার অর্জিত সম্পদের আলাদা বছর হিসাব করতে পারেন। তবে এভাবে হিসাব রাখাটা একটু কঠিন। কারণ এক্ষেত্রে আপনাকে এক বছরে কয়েকবার যাকাত আদায় করতে হবে।

যাকাত হিসাব করার সহজ পদ্ধতি

যাকাত হিসাব করার তরীকা ও মাসায়েলঃ

১।         যে অর্থ/সম্পদে যাকাত আসে সে অর্থ/সম্পদের ৪০ ভাগের ১ ভাগ যাকাত আদায় করা ফরয। মূল্যের আকারে নগদ টাকা দ্বারা বা তা দ্বারা কোনো আসবাবপত্র ক্রয় করে তা দ্বারাও যাকাত দেয়া যায়।

২।         যাকাতের ক্ষেত্রে চন্দ্র মাসের হিসাবে বতসর ধরা হবে। যখনই কেউ নেছাব পরিমান অর্থ/সম্পদের মালিক হবে তখন থেকেই যাকাতের বতসর শুরু ধরতে হবে।

৩।         সোনা রূপার মধ্যে যদি ব্রঞ্জ, রাং, দস্তা, তামা ইত্যাদি কোনো কিছুর মিশ্রণ থাকে আর সে মিশ্রণ সোনা রুপার চেয়ে কম হয়, তাহলে পুরোটাকেই সোনা রুপা ধরে যাকাতের হিসাব করা হবে-মিশ্রিত দ্রব্যের কোনো ধর্তব্য হবে না। আর যদি মিশ্রিত দ্রব্য সোনা রুপার চেয়ে অধিক হয়, তাহলে সেটাকে আর সোনা রুপা ধরা হবে না। বরং ঐ মিশ্রিত দ্রব্যই ধরা হবে।

৪।         যাকাত হিসাব করার সময় অর্থাৎ, ওয়াজিব হওয়ার সময় সোনা, রুপা, ব্যবসায়িক পণ্য ইত্যাদির মুল্য ধরতে হবে তখনকার (ওয়াজিব হওয়ার সময়কার) বাজার দর হিসাবে এবং সোনা রুপা ইত্যাদি যে স্থানে রয়েছে সে স্থানের দাম ধরতে হবে।

৫।         শেয়ারের মূল্য ধরার ক্ষেত্রে মাসয়ালা হল-যারা কোম্পানীর লভ্যাংশ অর্জন করার উদ্দেশ্যে নয় বরং শেয়ার ক্রয় করেছেন শেয়ার বেচা-কেনা করে লাভবান হওয়া এর উদ্দেশ্য, তারা শেয়ারের বাজার দর ধরে যাকাত হিসাব করবেন। আর শেয়ার ক্রয় করার সময় যদি মূল উদ্দেশ্য থাকে কোম্পানী থেকে লভ্যাংশ অর্জন করা এবং সাথে সাথে এ উদ্দেশ্যও থাকে যে, শেয়ারের ভাল দর বাড়লে বিক্রিয় করে দিব, তাহলে যাকাত হিসাব করার সময় শেয়ারের বাজার দরের যে অংশ যাকাতযোগ্য অর্থ/সম্পদের বিপরীতে আছে তার উপর যাকাত আসবে, অবশিষ্ট অংশের উপর যাকাত আসবে না।উদাহরন স্বরূপ শেয়ারের মার্কেট ভ্যালু (বাজার দর) ১০০ টাকা, তার মধ্যে ৬০ ভাগ কোম্পানীর বিল্ডিং, মেশিনারিজ ইত্যাদির বিপরীতে, আর ৪০ ভাগ কোম্পানীর নগদ অর্থ, কাঁচামাল ও তৈরী মালের বিপরীতে, তাহলে যাকাতের হিসাব করার সময় শেয়ারের বাজার দর অর্থাৎ, ১০০ টাকার ৬০ ভাগ বাদ যাবে। কেননা সেটা এমন অর্থ/সম্পদের বিপরীতে যার উপর যাকাত আসে না । অবশিষ্ট ৪০ ভাগের উপর যাকাত আসবে।

৬।         যাকাতদাতার যে পরিমান ঋণ আছে সে পরিমাণ অর্থ বাদ দিয়ে বাকিটার যাকাত হিসাব করবে। ঋণ পরিমাণ অর্থ বাদ দিয়ে যদি যাকাতের নেছাব পূর্ণ না হয় তাহলে যাকাত ফরয হবে না। তবে হযরত মাওলানা মুফতী তাকী উছমানী সাহেব বলেছেন, যে লোন নিয়ে বাড়ি করা হয় বা যে লোন নিয়ে মিল ফ্যাক্টরী তৈরী করা হয় বা মিল ফ্যক্টরীর মেশনারীজ ক্রয় করা হয়, এমনিভাবে যেসব লোন নিয়ে এমন কাজে নিয়োগ করা হয় যার মূল্যের উপর যাকাত আসে না- যেমনঃ বাড়ি ও ফ্যক্টরী বা ফ্যক্টরীর মেশিনারিজের মূল্যের উপর যাকাত আসে না-এসব লোন যাকাতের জন্য বাধা নয় অর্থাৎ, এসব লোনের পরিমান অর্থ যাকাত থেকে বাদ দেয়া যাবে না। হাঁ যে লোন নিয়ে এমন কাজে নিয়োগ করা হয় যার উপর যাকাত আসে, যেমনঃ লোন নিয়ে ফ্যাক্টরীর কাচামাল ক্রয়, এরুপ ক্ষেত্রে এ লোন পরিমাণ অর্থ যাকাতের হিসাব থেকে বাদ যাবে। মুফতী তাকী উছমানী সাহেব তার এ মাসলাটিকে শক্তিশালী যুক্তি দ্বারা প্রমাণিত করেছেন, অতএব তার এ মতটি গ্রহন করার মধ্যেই সতর্কতা রয়েছে।

৭।         কারও নিকট যাকাতদাতার টাকা পাওনা থাকলে সে পাওনা টাকার যাকাত দিতে হবে। পাওনা তিন প্রকারঃ

(ক)       কাউকে নগদ টাকা ঋণ দিয়েছে কিংবা ব্যবসায়ের পণ্য বিক্রি করেছে এবং তার মূল্য বাকী রয়েছে। এরূপ পাওনা কয়েক বছর পর উসুল হলে যদি পাওনা টাকা এত পরিমান হয় যাতে যাকাত ফরয হয়, তাহলে অতীত বতসরসমুহের যাকাত দিতে হবে। যদি একত্রে উসূল না হয়-ভেঙ্গে ভেঙ্গে উসুল হয়, তাহলে ১১ তোলা রূপার মূল্য পরিমাণ হলে যাকাত দিতে হবে। এর চেয়ে কম পরিমাণ উসূল হলে তার যাকাত ওয়াজিব হবে না-তবে অল্প অল্প করে সেই পরিমাণে পৌছে গেলে তখন ওয়াজিব হবে। আর যখনই ওয়াজিব হবে তখন অতীত সকল বতসরের যাকাত দিতে হবে। আর যদি এরুপ পাওনা টাকা নেছাবের চেয়ে কম হয় তাহলে তাতে যাকাত ওয়াজেব হবে না।

(খ)        নগদ টাকা ঋণ দেয়ার কারণে বা ব্যবসায়ের পণ্য বাকিতে বিক্রি করার কারণে পাওনা নয় বরং ঘরের প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র, কাপড়-চোপড়, চাষাবাদের গরূ ইত্যাদি বিক্রয় করেছে এবং তার মূল্য পাওনা রয়েছে, এরূপ পাওনা যদি নেছাব পরিমান হয় এবং কয়েক বছর পর উসূল হয় তাহলে ঐ কয়েক বতসরের যাকাত দিতে হবে। আর যদি ভেঙ্গে ভেঙ্গে উসুল হয় তাহলে যতক্ষণ পর্যন্ত সাড়ে বায়ান্ন তোলা রুপার মূল্য পরিমাণ না হবে ততক্ষন যাকাত ওয়াজিব হবে না। যখন উক্ত পরিমাণ উসূল হবে তখন বিগত বতসর সমূহের যাকাত দিতে হবে।

(গ)        মোহরের টাকা, পুরষ্কারের টাকা, খালা তালাকের টাকা, বেতনের টাকা ইত্যাদি পাওনা থাকলে এরূপ পাওনা উসূল হওয়ার পূর্বে যাকাত ওয়াজিব হয় না। উসূল হওয়ার পর ১ বতসর মজুদ থাকলে তখন থেকে তার যাকাতের হিসাব শুরু হবে। পাওনা টাকার যাকাত সম্পর্কে উপরোল্লিখিত বিবরণ শুধু তখনই প্রযোজ্য হবে যখন এই টাকা ব্যতীত তার নিকট যাকাতযোগ্য অন্য কোনো অর্থ/সম্পদ না থাকে। আর অন্য কোনো অর্থ/সম্পদ থাকলে তার মাসলা উলামায়ে কেরাম থেকে জেনে নিবেন।

৮।         যে ঋণ ফেরত পাওয়ার আশা নেই, এরূপ ঋণের উপর যাকাত ফরয হয় না। তবে পেলে বিগত সমস্ত বতসরের যাকাত দিতে হবে।

৯।         যৌথ কারবারে অর্থ নিয়োজিত থাকলে যৌথভাবে পূর্ণ অর্থের যাকাত হিসাব করা হবে না বরং প্রত্যেকের অংশের আলাদা আলাদা হিসাব হবে।

১০।        যেসব সোনা রূপার অলংকার স্ত্রীর মালিকানায় দিয়ে দেয়া হয় সেটাকে স্বামীর সম্পত্তি ধরে হিসাব করা হবে না বরং সেটা স্ত্রীর সম্পত্তি। আর যেসব অলংকার স্ত্রীকে শুধু ব্যবহার করতে দেয়া হয়, মালিক থাকে স্বামী, সেটা স্বামীর সম্পত্তির মধ্যে ধরে হিসাব করা হবে। আর যেগুলোর মালিকানা অস্পষ্ট রয়েছে তা স্পষ্ট করে নেয়া উচিত। যেসব অলংকার স্ত্রীর নিজস্ব সম্পদ থাকে তৈরী বা যেগুলো বাপের বাড়ি থেকে অর্জন করে, সেগুলো স্ত্রীর সম্পদ বলে গণ্য হবে। মেয়েকে যে অলংকার দেয়া হয় সেটার ক্ষেত্রেও মায়েকে মালিক বানিয়ে দেয়া হলে সেটার মালিক সে। আর শুধু ব্যবহারের উদ্দেশ্যে দেয়া হলে মেয়ে তার মালিক নয়। নাবালেগা মেয়েদের বিয়ে-শাদি উপলক্ষে তাদের নামে যে অলংকার বানিয়ে রাখা হয় বা নাবালেগা ছেলে কিংবা মেয়ের বিবাহ শাদীতে ব্যয়ের লক্ষ্যে তাদের নামে ব্যাংকে বা ব্যবসায় যে টাকা লাগানো হয় সেটার মালিক তারা। অতএব সেগুলো পিতা/মাতার সম্পত্তি বলে গণ্য হবে না এবং পিতা/মাতার যাকাতের হিসাবে সেগুলো ধরা হবে না। আর বালেগ সন্তানের নামে শুধু অলংকার তৈরী করে রাখলে বা টাকা লাগালেই তারা মালিক হয়ে যায় না যতক্ষণ না সেটা সে সন্তানের দখলে হয়। তাদের দখলে দেয়া হলে তারা মালিক, অন্যথায় সেটার মালিক পিতা/মাতা।

১১।        হিসাবের চেয়ে কিছু বেশি যাকাত দিয়ে দেয়া উত্তম। যাতে কোনো রূপ কম হওয়ার সম্ভাবনা না থাকে। প্রকৃতপক্ষে সেটুকু যাকাত না হলেও তাতে দানের ছওয়াব তো হবেই।

কারা যাকাত পাওয়ার যোগ্য?

ইসলাম ধর্মের বিধান অনুযায়ী, আট ধরণের মানুষকে যাকাত প্রদান করা যাবে।

মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে মহান রাব্বুল আলামিন যাকাত প্রদানের আটটি খাত নির্ধারণ করে দিয়েছেন। ইরশাদ হচ্ছে, “যাকাত তো সেসব লোকেরই জন্য, যারা অভাবগ্রস্ত, নিতান্ত নিঃস্ব, যারা তা সংগ্রহ করে আনে, যাদের অন্তরসমূহকে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করা হয়, ক্রীতদাস মুক্তির ক্ষেত্রে, ঋণগ্রস্তদের জন্য, আল্লাহর পথে এবং মুসাফিরদের জন্য। এটা আল্লাহর নির্ধারিত বিধান। আর আল্লাহ পাক সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।” [আল-কুরআন, সুরা তাওবা, আয়াত : ৬০।]

আয়াতের আলোকে যাকাত বণ্টনের আটটি খাত হলো- ১. ফকির (যার নিতান্ত সামান্য পাথেয় আছে), ২. মিসকিন (যার কিছুই নেই), ৩. যাকাত সংগ্রহের কার্যে নিয়োজিত ব্যক্তি (তার পারিশ্রমিক অনুযায়ী), ৪. দ্বীন ইসলামের প্রতি চিত্তাকর্ষণে কোনো অমুসলিম কিংবা ইসলামে অটল রাখার্থে নও মুসলিম, ৫. দাসদাসীর মুক্তি, ৬. ঋণগ্রস্ত ব্যক্তির ঋণমুক্তি, ৭. একান্ত ও শরিয়ত সম্মত আল্লাহর পথে যুদ্ধের ক্ষেত্রে এবং ৮. রিক্তহস্ত মুসাফির।

ব্যক্তিকে যাকাত দেয়ার পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানেও যাকাত দেয়া যায়।

যে চার শ্রেণির মানুষকে যাকাত দেওয়া যাবে না

আল্লাহর প্রিয় হাবিব তাকে (সুস্থসবল দেহবিশিষ্ট দেখে) বললেন, “দেখ! যাকাতের খাত নির্ধারণ মহান আল্লাহ কোনো নবী কিংবা অন্যকারো হাতে না রেখে স্বয়ং নিজেই আটটি ভাগে ভাগ করে দিয়েছেন।  তুমি ওই আট প্রকারের অন্তর্ভুক্ত থাকলে আমি তোমাকে যাকাতের অংশ দিতে পারি, অন্যথা নয়।” [সুনানু আবু দাউদ, যাকাত অধ্যায়। মিশকাতুল মাসাবিহ, হাদিস নং-১৮৩৫।]

যাকাতের নির্ধারিত খাত আছে। এর বাইরের কাউকে যাকাত দেওয়া যাবে না। ইসলামি শরিয়ত মতে, যাকাতের অর্থ যাদের দেওয়া যাবে না তাদের একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা উল্লেখ করা হলো।

১. অমুসলিম

একদল বিশেষজ্ঞের মতে, অমুসলিম-কাফেরকে যাকাত দেওয়া জায়েজ নেই। আরেকদল আলেম বলেন, পাপাচারী মুসলিম ব্যক্তিকেও যাকাত দেওয়া যায়েজ নেই। তবে ইমাম আবু হানিফা (রহ.) বলেছেন, যাকাতের ব্যাপারে এ ধরনের কোনো শর্তারোপ পবিত্র কোরআন থেকে প্রমাণিত নয়। তাই নিঃস্ব যে কোনো ব্যক্তিকেই যাকাতের অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করা যেতে পারে।

২. নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক ও তার সন্তানদের

সব বিশেষজ্ঞ একমত, নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক এমন ব্যক্তিকে যাকাতের অর্থ দিয়ে সহযোগিতা করা জায়েজ নেই। এবং তার নাবালক সন্তানদেরও যাকাতের অর্থ দেওয়া যাবে না। এমন ব্যক্তির যদি অর্থনৈতিক সহযোগিতার প্রয়োজন হয় তাহলে তাকে ঋণ, করজে হাসানাহ কিংবা সাধারণ দান-খয়রাত করে তার পাশে দাঁড়ানো বিত্তবানদের দায়িত্ব।

৩. হাশিম বংশের লোকজন

হাশিম বংশ তথা নবীজি (সা.) এর বংশের লোকজনকে যাকাতের অর্থ দেওয়া যায়েজ নেই। নবীজি (সা.) নিজ বংশের লোকদের জন্য যাকাতের অর্থ ভোগ করা হারাম করেছেন। এটা নবীবংশের মহান মর্যাদাকে সমুন্নত করেছে।

৪. নিজের ঊর্ধ্বতন ও অধঃস্তন স্বজনদের

আপন বাবা-মা, দাদা-দাদি, নানা-নানি এভাবে ঊর্ধ্বতন স্বজন এবং নিজের ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনি এভাবে অধঃস্তন প্রিয়জনদের যাকাতের অর্থ দেওয়া যাবে না। সামর্থ্যবানরা অসহায় আত্বীয়দের পাশে সবসময় দাঁড়াবে, এ জন্য বাধ্যতামূলক দান থেকে এদের আলাদা রেখেছে শরিয়ত। একইভাবে স্বামী-স্ত্রী একজন আরেকজনকে যাকাত দিতে পারবে না।

আয়কর দিলে কি মুসলিমদের যাকাত দিতে হয়?

ইসলামের নবী মোহাম্মদ যখন ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে মদিনায় গিয়ে ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা চালু করেন, তখন সে রাষ্ট্রে যাকাত ব্যবস্থা চালু হয়েছে।

ইসলামী চিন্তাবিদরা বলছেন, মুসলমানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরআন শরীফে যাকাত সম্পর্কে নির্দেশনা দেয়া আছে।

মদিনায় যখন ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তারপর থেকে প্রায় ১৪০০ বছর পার হয়েছে। রাষ্ট্র ব্যবস্থায় পরিবর্তন এসেছে । এখনকার রাষ্ট্র ব্যবস্থায় নাগরিকরা সরকারকে আয়কর দিচ্ছেন। এ আয়কর হচ্ছে রাষ্ট্র পরিচালনার মূল অর্থনৈতিক ভিত্তি।

নাগরিকরা যেখানে সরকারকে আয়কর দিচ্ছেন, সেখানে যাকাত দেয়া কতটা বাধ্যতামূলক? এ নিয়ে অনেকের মনে প্রশ্ন আছে। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি কী?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতির অধ্যাপক ড: মুহাম্মদ ইব্রাহিম বলছেন আয়কর দিলেও যাকাত দিতে হবে।

অধ্যাপক ইব্রাহিম বলেন, “আয়কর হচ্ছে রাষ্ট্রীয় সেক্যুলার ট্যাক্স। কিন্তু যাকাত হচ্ছে রিলিজিয়াস (ধর্মীয়) ট্যাক্স। আল্লাহর সাথে সম্পর্ক রক্ষার ব্যাপারটা প্রধান্য দিতে হলে তাকে যাকাত দিতেই হবে।”

তিনি উল্লেখ করেন, ইসলামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা থাকলে আয়কর দিতে হতো না। যাকাত আয়করের বিকল্প হতো। অধ্যাপক ইব্রাহিম বর্ণনা করেন, সম্পদের ‘শুদ্ধতার’ জন্য যাকাত দেয়া অপরিহার্য। ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে সামাজিক বৈষম্য কমিয়ে আনার চিন্তা থেকে ইসলামে যাকাত ব্যবস্থা চালু হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

“যাকাত ব্যবস্থা ইসলামী রাষ্ট্রের আর্থিক এবং রাজস্ব সংক্রান্ত বিধান। ইসলামী রাষ্ট্রে আয়করের ব্যবস্থা নাই। ইসলামী রাষ্ট্রে যাকাত ব্যবস্থা,” বলছিলেন অধ্যাপক ইব্রাহিম।

ইসলামী চিন্তাবিদরা বলেন, আয়কর এবং যাকাত- দুটোই রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা। তবে পার্থক্য হচ্ছে, যাকাতের ক্ষেত্রে ইসলামী রাষ্ট্র হতে হবে এবং আয়করের ক্ষেত্রে ইসলামী শরিয়ার বাধ্যবাধকতার কোন বিষয় নেই।

আয়কর দিতে হয় মোট আয়ের উপর এবং যাকাত দিতে হয় মোট আয় থেকে ব্যয় বাদ দিয়ে উদ্বৃত্ত সম্পদের উপর।

বাংলাদেশের অন্যতম শীর্ষ স্থানীয় ইসলামী চিন্তাবিদ ড: শমসের আলী বলছেন, আয়কর দিলেও যাকাত দিতে হবে।

তিনি বলছেন, একটি রাষ্ট্র যদি আদর্শ ইসলামিক রাষ্ট্র হয় তাহলে আয়কর এবং যাকাত – এ দুটো একসাথে দেবার প্রয়োজন হতো না। তখন শুধু যাকাত দিলেই হতো।

ইসলামি চিন্তাবিদরা বলছেন, ইসলাম ধর্মের দর্শন অনুযায়ী রাষ্ট্রের তরফ থেকে যাকাত আদায় এবং সেটির ব্যবস্থাপনা করার কথা। কিন্তু কোন রাষ্ট্র যদি ইসলামিক রাষ্ট্র না হয়, তাহলে সেখানকার নাগরিকরা নিজ উদ্যোগে তার উদ্বৃত্ত সম্পদ হিসেব করে যাকাত দেবে।

ইসলামি চিন্তাবিদরা মনে করেন, গত দেড় হাজার বছরে পৃথিবীতে রাষ্ট্র ব্যবস্থায় অনেক কিছু পরিবর্তন হলেও ইসলামের দৃষ্টিতে যাকাতের মূল দর্শন পরিবর্তন হয়নি।

সেক্ষেত্রে বর্তমান রাষ্ট্র ব্যবস্থায় আয়কর এবং ইসলামের দৃষ্টিতে যাকাত – এ দুটো ভিন্ন বিষয় হিসেবেই থাকছে।

যাকাত আদায়ের সময়

যাকাত আদায়ের জন্য নির্দিষ্ট কোন সময়ের বাধ্যবাদকতা নেই। তবে রমাদান মাসই যাকাত আদায়ের সর্বোত্তম সময়। রমাদানে দান-সদাকাহ করলে অন্য সময়ের চেয়ে ৭০ গুণ বেশি সাওয়াব লাভ হয়। তাই পবিত্র রমাদান মাসে মু’মিন বান্দারা একসঙ্গে গরীবের হক যাকাত ও ফিতরা আদায় করে থাকে।

দারিদ্র্য বিমোচন ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে মাহে রমাদানই অধিক সওয়াব প্রাপ্তির জন্য যাকাত আদায়ের উপযুক্ত মৌসুম ও শ্রেষ্ঠতর সময়। রমাদান মাসে ধনী লোকেরা দরিদ্রদের যাকাত প্রদানের ফলে উভয় শ্রেণির মানুষের মধ্যে পারস্পরিক ভ্রাতৃত্ববোধ গড়ে উঠে।

অভাবগ্রস্ত, অসহায়, সম্পদহীন, কর্মহীন, এতিম, বিপদ ও দায়গ্রস্ত মানুষকে সহায়তা করা আল্লাহ তা‘আলার সুস্পষ্ট নির্দেশ হলেও অত্যন্ত বিস্ময়কর এই যে, আমাদের অনেকেই এ ব্যাপারে খর্বহস্ত। ধন-সম্পদের প্রাচুর্য থাকলেও মানুষের সহায়তায় এগিয়ে আসতে মন চায় না। বলার অপেক্ষা রাখে না, মানুষকে সহায়তা করার মতো মহৎ কাজ বা সৎকর্ম আর কিছু হতে পারে না। বর্তমান বিশ্বে ‘করোনা ভাইরাস’ মানুষকে সাহায্য ও সহায়তা করার একটা সুযোগ এনে দিয়েছে।

যাকাত আদায় না করার ভয়াবহ পরিণতি

যাকাত প্রদানে যারা কার্পণ্য করবে, তাদের বিরুদ্ধে পবিত্র কুরআন এবং হাদীস শরিফে কঠোর সতর্কবাণী উচ্চারিত হয়েছে।

আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “আর আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে যা তোমাদেরকে দিয়েছেন তাতে যারা কৃপণতা করে তারা যেন কিছুতেই মনে না করে যে, এটা তাদের জন্য মঙ্গল। না, এটা তাদের জন্য অমঙ্গল। যে সম্পদে তারা কৃপণতা করেছে কিয়ামতের দিন তা-ই তাদের গলায় বেড়ি হবে। আসমান ও যমীনের স্বত্ত্বাধিকার একমাত্র আল্লাহরই। তোমরা যা কর আল্লাহ তা বিশেষভাবে অবগত।” [সূরা আল-ইমরান : ১৮০]

বুখারি ও মুসলিম শরিফের এক বর্ণনায় এও এসেছে যে, যাকাত অনাদায় সম্পত্তিকে কিয়ামতের ময়দানে বিষধর সাপে রূপ দিয়ে কৃপণ ধনবানদের গলায় জড়িয়ে দেয়া হবে। সাপটি তার উভয় অধরপ্রান্তে দংশন করবে এবং বলবে, আমিই তোমার ঐ ধন, আমিই তোমার পুঞ্জিভূত সম্পদ।’’ [সহিহ বুখারি, হাদিস নং-১১১, সহিহ মুসলিম, হাদিস নং-২৩৪৩।]

দেশের সংকটাপন্ন এ দুরবস্থায় ধনাঢ্যদের যাকাত আদায়ের মোক্ষম সুযোগ। অসহায়দের পাশে দাঁড়াতে যাকাতের যথাযথ বণ্টনব্যবস্থা এ ক্রান্তিলগ্নে সুফল বয়ে আনবে। পুঞ্জিভূত সম্পদের অট্টালিকা না গড়ে দিনমজুর, শ্রমিক ও ফকির-মিসকিনদের প্রতি তাদের প্রাপ্য হিসেবে যাকাত প্রদান করে নিজেদেরকে কঠিন আযাবের সম্মুখীন হওয়া থেকে বিরত রাখতে এখনই যেন আমরা উদ্যোগী হই।

যে কথাটা মনে রাখা উচিত, যাকাত কোনো প্রকারের উপহার, উপঢৌকন কিংবা দয়ার্চনা নয়, এটি গরিবের হক। অসহায়ের অধিকার। তাই যার যে অধিকার, তা যথাযথ আদায়ে আমরা সচেষ্ট হই।

যাকাত, দান ও সদাকার অর্থ গরীব-দুঃখী-অসহায়দের মধ্যে বণ্টন করে দিলে দানের সাওয়াব যেমন পাওয়া যাবে, তেমনি বিপন্ন ও বিপদগ্রস্ত মানুষ উপকার লাভ করবে। যাকাত, বেশি বেশি দান-খয়রাত ও সাদাকা করার ব্যাপারে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার উদ্যোগ ও পদক্ষেপ নিতে হবে। যাকাত আদায় এবং অভাবী অসহায়দের পাশে দাঁড়ানোর এটাই শ্রেষ্ঠ সময়।

সূত্রঃ

  • আহকামে যিন্দেগী;
  • dmpnews.org/
  • daily-bangladesh.com/opinion/244543
  • bbc.com/bengali/news-56755975
  • thefinancialexpress.com.bd/bn/
  • bangla.24livenewspaper.com/ramadan/79618-zakat-cannot-be-given-to-those-four-classes-of-people
  • bbc.com/bengali/news-40354898
  • m.dailyinqilab.com/article/291771/