শিক্ষাবিদ, থিঙ্ক ট্যাঙ্ক এবং ভবিষ্যৎদ্রষ্টা বক্তাগণ চতুর্থ শিল্পবিপ্লব বিষয়ে কথা বলেন তারা নিম্নবর্ণিত উদীয়মান প্রযুক্তিগুলোকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকেন:
– কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI);- রোবোটিক্স;
– ইন্টারনেট অফ থিংস (IoT);
– থ্রি-ডি (3D)/ত্রি-মাত্রিক প্রিন্টিং;
– জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং; এবং
– কোয়ান্টাম কম্পিউটিং।
বর্তমান চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে বিশ্বের সবাইকে জানতে হবে কীভাবে AI প্রোগ্রাম করতে হয় বা বিভিন্ন প্রোগ্রামিং ভাষায় সাবলীল (বা অন্তত অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন) হতে হবে এবং আমাদেরকে প্রস্তুতির অংশ হিসেবে উপাত্ত বিশ্লেষণ বা ব্লকচেইন প্রযুক্তি সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকতে হবে প্রয়োজনে প্রয়োজনীয় কোর্স করে নিতে হবে পাশাপাশি এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। তখনই এগিয়ে যাওয়ার পথে অগ্রগতি সাধিত হবে। বিভিন্ন নিবন্ধ পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, এটা সম্পূর্ণ সত্য নয় যে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সুবিধা গ্রহণে শুধুমাত্র প্রযুক্তিগত দক্ষতার প্রয়োজন হবে। প্রকৃতপক্ষে, নিবন্ধক লেখকগণ সবাই একটা বিষয়ে একমত ‘ভবিষ্যতের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতার অধিকাংশই সফ্ট স্কিল যা নিশ্চিত করতে পারে জীবনব্যাপী শিক্ষা।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে যে মৌলিক চারটি সফ্ট স্কিল এর ক্ষেত্র রয়েছে যার প্রতিফলণ প্রায় সব নিবন্ধেই উপস্থাপিত হয়েছে তা নিম্নে উল্লেখ করা হলো:
১। বিশ্লেষনাত্মক চিন্তা
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে বিশ্লেষনাত্বক চিন্তা করার দক্ষতা হলো সবথেকে বড় একটি সম্পদ। এই চিন্তা করার সক্ষমতা সহজেই ছড়িয়ে পড়ে এবং মানব জীবনে অনেক প্রভাব ফেলে থাকে। বিশ্লেষনাত্বক চিন্তা করা দক্ষতার গুরুত্ব অপরিসীম। কেননা বিশ্লেষনাত্বক চিন্তা হচ্ছে এমন একটি দক্ষতা যা কাজে লাগিয়ে জটিল সমস্যা মোকাবেলা, নতুন প্রযুক্তিগত তথ্য অর্জন, নতুন ধারণা ও অভিজ্ঞতা অর্জন, সমস্যা সমাধান করা হয়ে থাকে।
বিশ্লেষণাত্মক চিন্তা শক্তির উন্নয়নের লক্ষ্যে নিম্নবর্ণিত সক্ষমতা অর্জনে সচেষ্ট থাকা জরুরি:
- সঠিক তথ্য সংগ্রহ করার ক্ষমতা;
- গাণিতিক ক্ষমতা;
- কৌশলগত চিন্তা দক্ষতা; এবং
- বিস্তারিত সতর্কতা।
গঠণমূলক সমালোচনা চিন্তা শক্তির মাধ্যমে সংশ্লেষণ করার ক্ষমতা, সংযোগ সমন্বয়, ম্যাক্রো থেকে মাইক্রো পৃথকীকরণ করার ক্ষমতা ভবিষ্যতের জন্য একটি অপরিহার্য দক্ষতা হবে। ব্যবহারকারীর দৃষ্টিকোণ থেকে একটি ইন্টারফেস বা ইন্টারঅ্যাকশন ডিজাইন করার ক্ষমতা, কীভাবে কেউ আপনার পরিষেবাগুলি অ্যাক্সেস করবে বা আপনার পণ্যগুলি ব্যবহার করবে সে সম্পর্কে সর্বদা সহানুভূতিশীলতাই নিশ্চিত করবে বিশ্লেষনাত্মক চিন্তা।
২। আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা
আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা বা ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স মূল কর্মদক্ষতা হিসেবে কাজ করবে উপরে বর্ণিত কর্মদক্ষতাগুলোর ক্ষেত্রে। চলমান এবং আগত শতাব্দিতে কর্মক্ষেত্রে এ দক্ষতা আবশ্যক, কোন বিকল্প নেই। কর্মক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দিতা করবে রোবট। বিশ্ব প্রতিযোগিতায় টিকতে হলে মানব সম্পদের আলোচ্য দক্ষতা থাকা আবশ্যক। পরিবর্তন কারো জন্য অপেক্ষা করবে না তার সহজাত ধর্ম অনুযায়ী পরিবর্তিত হবেই, মানব নিজেকে সম্পদে পরিণত করতে চাইলে তাঁকে পরিবর্তনের সাথে যেতেই হবে। আপনি কার সাথে ইন্টারঅ্যাক্ট করছেন তার উপর নির্ভর করে এর মধ্যে অভিযোজনযোগ্য এবং নমনীয় হওয়া অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
ইমোশনাল ইন্টিলিজেন্স বাআবেগীয় বুদ্ধিমত্তার বিকাশ ভালো কাজের দক্ষতা উন্নয়ন ও চাপ মোকাবিলা করার ক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি ব্যক্তির পারস্পরিক সম্পর্কের উন্নতি ঘটায়, এমনকি দ্বন্দ্বমূলক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। বিধায় চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সুবিধা গ্রহণে আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে তাতে কোন সন্দেহের অবকাশ নাই।
আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা পাঁচটি উপাদান নিয়ে গঠিত। এগুলো সবই মানসিক উপাদানঃ
- স্ব-সচেতনতা;
- স্ব-ব্যবস্থাপনা/আত্মনিয়ন্ত্রণ;
- স্ব-উদ্যম;
- অন্যকে উপলব্ধি করা; এবং
- সামাজিক দক্ষতা।
কর্মক্ষেত্রে আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা
উচ্চ আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন কর্মীগণের ‘চিন্তার স্বচ্ছতা’ এবং প্রতিকুল ও স্ট্রেসফুল পরিস্থিতিতে স্থিরতা তাঁদেরকে কর্মক্ষেত্রে অসাধারণ কৃতিত্ত্বের স্বীকৃতি অর্জনে সহায়তা করে।
নিম্নবর্ণিত উল্লেখযোগ্য আবেগীয় দক্ষতা কর্মক্ষেত্রের সকল বিষয়ের উপর প্রভাব ফেলে থাকে:
- সঠিকভাবে নিজেকে মূল্যায়নে পারঙ্গমতা;
- আত্ম-নিয়ন্ত্রণ দক্ষতা;
- শোভন বিবেচনা দক্ষতা;
- অভিযোজন বা খাপ-খাওয়ানোর দক্ষতা;
- সৃজনশীল উদ্ভাবনী দক্ষতা;
- প্রতিশ্রুতির প্রতি সচেতনতা;
- কর্ম-উদ্যোগ গ্রহণে দক্ষতা;
- গঠণমূলক রাজনৈতিক সচেতনতা;
- হতাশা পরিহারপূর্বক আশাবাদী থাকার দক্ষতা;
- অপরকে বুঝার ক্ষমতা;
- বিরোধ বা দ্বন্দ্ব নিরসন বিষয়ক ব্যবস্থাপনা দক্ষতা;
- দলগত কাজ করার দক্ষতা;
- গঠণমূলক যোগাযোগ দক্ষতা;
- পরিবর্তন ব্যবস্থাপনার দক্ষতা, ইত্যাদি।
আবেগীয় বুদ্ধিমত্তার উন্নতি করে একজন কর্মী কর্মক্ষেত্রে অনেক বেশি অবদান রাখতে পারেন কারণ কাজের ধরন ও পর্যায় ভেদে বিভিন্ন ধরনের আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা প্রয়োজন হয়ে থাকে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে পারস্পরিক সমঝোতা, পরিবর্তনকে মেনে নেয়া, পরিবর্তন ব্যবস্থাপনা, সমন্বয় সাধন ইত্যাদির লক্ষ্যে এ বিপ্লবের প্রস্তুতি হিসেব অধিক গুরুত্বপূর্ণ অর্থ বহন করে।
৩। সৃজনশীলতা
সৃজনশীলতা বলতে এমন ধারনাকে বোঝায় যেখানে কিছু প্রকার বিষয়গত মান থাকে (যেমন একটি ধারণা, সাহিত্যকর্ম, চিত্রকর্ম বা সংগীত রচনা, সমাধান, একটি আবিষ্কার ইত্যাদি), যা গুণগত প্রেরণা, বুদ্ধি এবং জ্ঞানের সাথে সম্পর্কিত। সৃজনশীলতার মানেই হল যে আপনি ক্রমাগত নতুন পণ্য বা উন্নত পরিষেবা, বা আপনার ব্যবসার জন্য কাজ করার বা প্রযুক্তি ব্যবহার করার উপায় এবং এমনকি যে কোনও পরিস্থিতি সম্পর্কে চিন্তা করার নতুন উপায় সম্পর্কে চিন্তা করছেন৷
সৃজনশীলতা সাধারণ বুদ্ধিমত্তার মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করে। ব্যক্তিত্বের ধরন, মানসিক ও স্নায়বিক প্রক্রিয়া, মানসিক স্বাস্থ্য বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণ ইত্যাদির মাধ্যমে সৃজনশীলতা বৃদ্ধিতে সহায়ক।
জাতীয় ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে এবং উদ্ভাবন ও শিখনে কার্যকারিতা উন্নত করতে সৃজনশীলতা প্রয়োজন। সৃজনশীলতা কয়েক ধরণের হতে পারে, যেমন:
- উদ্ভাবনী সৃজনশীলতা;
- কারিগরি সৃজনশীলতা;
- সংযোগকারী সৃজনশীলতা;
- তত্বাবোধিনী সৃজনশীলতা; এবং
- বিশ্লেষনী সৃজনশীলতা।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে সফলতা লাভের জন্য ডিজিটাল সংযোগ খুবই জরুরি যা নিশ্চিত করতে পারে মেধা ও সৃজনশীলতা। মেধার বিকাশ, প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন ও সৃজনশীলতা ব্যতীত এগিয়ে যাওয়া কষ্টসাধ্য বিষয়। কারণ একমাত্র মেধা এবং সৃজনশীল মানবসম্পদই চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে নেতৃত্ব দিতে পারবে। তাই চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রারম্ভেই এ বিষয়ে উৎকর্ষতা সাধন নিশ্চিত করতে হবে তবেই এ বিপ্লবের সাফল্য ধরা দিবে।
৪। যোগাযোগ এবং সহযোগিতা
উপাত্তে পূর্ণ বিশ্বের মধ্য থেকে অর্থবহ তথ্য লাভের জন্য প্রয়োজন যোগাযোগ ও সহযোগিতা। কার্যকরভাবে যোগাযোগ নিশ্চিত করতে আবশ্যক হয় লিখিত, মৌখিক এবং আন্তঃব্যক্তিক দক্ষতার। দলীয় কাজও গুরুত্বপূর্ণ হবে কারণ বেশিরভাগ কাজই হবে সহযোগিতামূলক।
ডিজিটাল বিশ্ব তথা বাংলাদেশকে টেকসই করতে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি, বিজ্ঞান, প্রকৌশল ও প্রযুক্তি এবং উচ্চতর প্রযুক্তির সঙ্গে সম্পর্কিত যেমন- ডিজিটাল ডেভেলপমেন্ট, ডিজিটাল টেকনোলজি, বায়োটেকনোলজি, ন্যানোটেকনোলজি, অ্যাডভান্স টেকনোলজি, ইন্সট্রাকশনাল টেকনোলজি Robotics, IT/ITES, Cloud Computing, VLSI (Very-Large-Scal-Integration), Navigation (Vehicle), Hardware Navigation, †reen technology, ই-কমার্স, সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং, টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ারিং, নেটওয়ার্ক অ্যান্ড কমিউনিকেশন ম্যানেজমেন্ট, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবস্থাপনা, নেটওয়ার্ক অ্যান্ড কমিউনিকেশন ম্যানেজমেন্ট, সাইবার নিরাপত্তা ও ব্যবস্থাপনা, ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনাসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে শিক্ষাদান, গবেষণা ও জ্ঞানের উৎকর্ষ সাধনের ব্যবস্থা করা জরুরি। নিশ্চিত করা প্রয়োজন চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পারস্পরিক যোগাযোগ ও সহযোগিতার সেতুবন্ধন।
চলমান দশকে এবং আসন্ন চ্যালেঞ্জের প্রতিক্রিয়া হিসাবে প্রয়োজনীয় দক্ষতার সমন্বয় ঘটানোর লক্ষ্যে সকলকেই গঠণমূলক সমালোচনা চিন্তা-ভাবনা, সমস্যা সমাধান, সৃজনশীলতা, মানসিক বুদ্ধিমত্তা, সহযোগিতা এবং যোগাযোগের একটি মিথস্ক্রিয়া, পারস্পরিক বোঝাপড়া এবং ব্যবহারিক প্রয়োগ অত্যন্ত জরুরি। ভবিষ্যতের সফলতার জন্য সবাইকে সাথে নিয়ে জ্ঞানের নমনীয়তা ও জীবনব্যাপী শিক্ষার মাধ্যমে বর্ণিত দক্ষতা দিয়ে জীবনকে সজ্জিত করতে হবে।
© Md. Abdur Rahman Miah ACIArb, Lifelong Learner, www.armiah.com