শিশুরা সাধারণত যৌন নিপীড়নের শিকার হলে তা সঠিকভাবে প্রকাশ করতে পারে না৷ তবে তাদের দৈনন্দিন আচরণের পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করলে মা-বাবা অথবা পরিবারের আস্থাভাজন সদস্যরা তা চিহ্নিত করতে পারেন। যেমন: শিশু বিশেষ কোন ব্যক্তিকে দেখলে ভীত হয়ে পড়ে বা তার উপস্থিতিতে নিজেকে লুকানোর চেষ্টা করতে পারে পূর্বে হয়ত তার কাছে যেত, বিশেষ কোনো বাসা বা বাড়ীতে যেতে না চাইতে পারে, বিশেষ কোনো স্থানকে ভয় পেতে পারে, কোনো শিশু হয়ত অন্য সময়ে বিছানায় প্রস্রাব করত না কিন্তু হঠাৎ করে বিছানায় প্রস্রাব করা শুরু করতে পারে, কোনো ব্যক্তিগত বিশেষ অঙ্গে ব্যাথার কথা বলতে পারে, ঘুমের মধ্যে হঠাৎ চিৎকার করে উঠতে পারে, অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করতে পারে, অশ্লীল শব্দ ব্যবহার করতে পারে যা পরিবার থেকে শেখানো হয় নাই ইত্যাদি৷ মা-বাবাকে এসব বিষয়সমূহ সতর্কতার সাথে খেয়াল করতে হবে বা নিগূঢ়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে জানতে সচেষ্ট থাকতে হবে। সেইসাথে শিশুর প্রতি পরিচিতজন বা আত্মীয়স্বজন কেমন আচরণ করে, তাদের আচরণে সন্দেজনক কোন কিছু পরিলক্ষিত হয় কি না সেটা ভদ্রোচিতভাবে বিশ্লেষণ করতে হবে। এমন কারুর কাছে শিশুকে রাখা যাবে না, যার মাধ্যমে শিশুর যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার আশঙ্কা আছে। তার স্কুল, তার খেলার জায়গা, তার বেড়ানোর জায়গায় যেসব আশঙ্কা আছে, সেসব সম্পর্কে তাকে কৌশলে সচেতন করতে হবে। পরিবারের বা আশেপাশের আত্মীয়স্বজনরা কে কেমন রুচির অধিকারী তা জানার চেষ্টা করা। শিশুদের কারো প্রতি কোনো অভিযোগ থাকলে তা আগ্রহ নিয়ে শোনা এবং প্রয়োজনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
সন্তান বড় হলে সতর্ক করা যায়, বলা যায় বা বোঝানো যায় কিন্তু ছোট শিশুদের বলা বা বোঝানো দুষ্কর। জোর করে বোঝাতে গেলে ভালোর চাইতে খারাপ হতে পারে। এক্ষেত্রে পারিবারিক সুস্থ সুরক্ষা সর্বাগ্রে নিশ্চিতকরণ জরুরি। শিশুকে কখনোই কোনো পরিবার, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়ের বাসা, পরিচিতজন, গৃহকর্মী, গাড়ীচালক, ফাঁকা বাসায় গৃহশিক্ষক ইত্যাদির কাছে একা রাখা বা তাদের জিম্মায় দেওয়া মোটেই উচিত হবে না, অর্থাৎ কোমলমতি শিশুদের যতটা সম্ভব বাবা-মায়ের তত্ত্বাবধানে এবং তাঁদের দৃষ্টিসীমার মধ্যে রাখতেই হবে। কোনো শিশুকেই কারো সঙ্গেই একা যেতে না দেয়া বা ঘরে একা না রাখা। শিশুরা কারো সঙ্গে একাকি সময় দিচ্ছে কিনা তা পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। স্কুল বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাওয়ার প্রতি শিশুদের অনীহা বা অনাগ্রহ পরিলক্ষিত হলে তার কারণ অনুসন্ধান করতে হবে। পাশাপাশি শিশুরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোনো প্রকার নির্যাতনের শিকার বা তাদের কোনো প্রকার বুলিং করা হচ্ছে কি না তা জানার চেষ্টা করা ও সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। বেশিরভাগ অভিভাবকের যৌন বিষয়ক বাস্তব অভিজ্ঞতা ও সঠিক জ্ঞান না থাকার কারণে শিশু এবং নারীরা যৌন নিপীড়নের বা নিগ্রহের শিকার হন। অনেকেই সন্তানকে কিভাবে নিজেকে যৌন নিপীড়নের হাত থেকে রক্ষা করা যায় সে উপায় সম্পর্কিত দক্ষতাগুলো না শিখিয়েই বাইরের দুনিয়ায় পাঠিয়ে দেই যা হিতে বিপরীত হয়। তাই আপামর সকল অভিভাবকের উচিত এ সংশ্লেষে বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে যুক্তিসঙ্গতভাবে ব্যাপক চিন্তা করা। পরিবারের শিশুদের আচার আচরণের কোনো পরিবর্তন হচ্ছে কিনা লক্ষ রাখা।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত ছেলে মেয়েদের সাথে অভিভাবকদের সুন্দর, সাবলীল এবং বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা দরকার। যাতে তারা স্কুল কলেজে তার সঙ্গে কে কী করছে তা সহজেই অবগত হওয়া যায়। পারিবারিক সম্পর্ক স্বাভাবিক না হওয়ার কারণে অধিকাংশ কিশোর, কিশোরী এবং মেয়েরা তাদের সঙ্গে ঘটা নিপীড়ন বা নিগ্রহের কথা পরিবারকে জানাতে ব্যর্থ হয়। ফলশ্রুতিতে এসকল কোমলমতি শিশু, কিশোর, কিশোরী নির্যাতনের শিকার হয়ে মানসিক অবসাদগ্রস্থতায় ভোগে, যা পরবর্তীতে স্থায়ী মানসিক রোগে পরিণত হয় এবং আত্মহত্যায় প্ররোচিত করে।
প্রত্যেকটি পরিবারের উচিৎ যৌন বিষয়ক নিরাপত্তার বিষয়ে শিশুদের সুশিক্ষিত করা, যেন তারা নিজেদের বিরুদ্ধে কোনো অন্যায় হলে তা পরিবারকেই প্রথমে জানাতে পারে। যথাযথ জ্ঞানের অভাবে অনেকে বুঝতেই পারে না তাদের যৌন নিপীড়ন করা হচ্ছে। বিধায় পরিবারের প্রথম দায়িত্ব বা পদক্ষেপই হতে হবে শিশুদের যৌন বিষয়ে সচেতন করা।
বিভিন্ন গবেষণা ও জরিপে শিশু যৌন নিপীড়ন সংক্রান্ত যে চিত্র ও পরিসংখ্যান পাওয়া যায় তা থেকে দেখা গেছে, আঠারতম জন্মদিনের আগেই প্রতি তিনটি মেয়ের একটি মেয়ে এবং প্রতি ছয়টি ছেলের একটি ছেলে যৌন নিপীড়নের শিকার হয়। আর এদের শীর্ষে থাকা শতকরা পঁচাশি ভাগ নিপীড়কই পূর্ব পরিচিত বা আগে থেকেই চেনা বা জানা। অবাক হতে হয় যখন দেখা যায় পরিচিতজন ভাল ও নিষ্পাপ মুখোশের আড়ালে কোমলমতি শিশুটিকে যৌন নির্যাতন বা নিগ্রহ বা ধর্ষণের জন্য ওৎ পেতে থাকে। মানুষরূপী পরিমলরা শুধু যে নামকরা স্কুলের ছাত্রীদের পিছনে লেগে থাকে তা না এরা শহর, বন্দর কিংবা গ্রামেও অবস্থান করে। এরা কখনও আবির্ভুত হয় আত্মীয়, বন্ধু, সহকর্মী, শিক্ষক, ওস্তাদ, সহপাঠী ইত্যাদি হিসেবে। এরা মুখোশধারী শয়তান বা বহুরূপী প্রাণী যারা বাবা-মা এর অগোচরে তাদের কোমলমতি শিশু বা সন্তান কে খুব বিশ্বাসী বন্ধুর আচরণে প্রভাবিত করে নিগৃহীত করার প্রচেষ্টায় লিপ্ত।
যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধের শিক্ষা প্রদান খুব সহজ হলেও একবার কোনো শিশু যৌন নিপীড়নের শিকার হয়ে গেলে বিষয়টি অধিক জটিল হয়ে পড়ে যা খুবই ধ্বংসাত্মক এবং জীবন বদলে দেওয়ার মত ঘটনায় পরিণত হতে পারে। তাই শিশুদেরকে খুবই অল্প বয়স থেকে যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধের পদ্ধতি সম্পর্কে শিক্ষা দিতে হবে। শিশুরা কথা বলা শুরু করা থেকেই তাদের স্ব স্ব দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো নিয়ে কৌতুহলী হয়ে থাকে এবং সেগুলোর নামও সঠিকভাবে বলতে শেখে। তাই পরিবার যখন হাত, পা, মাথা, কনুই ইত্যাদি সম্পর্কে শেখায় তখনই তাদের জননাঙ্গ সম্পর্কেও জানাতে হবে। যা শিশুদেরকে কেউ খারাপভাবে স্পর্শ করলে তারা সুস্পষ্টভাবে বলতে পারবে বা জানাতে পারবে তাদের কোন অঙ্গে স্পর্শ করা হয়েছিল। শিশুকে দৃঢ়তার সাথে শেখাতে হবে জননাঙ্গ, মলদ্বার, স্তন এবং স্তনবৃন্ত ইত্যাদি তাদের একান্তই ব্যক্তিগত অঙ্গ পাশাপাশি তার তাকে এটাও জানাতে হবে যে, তার মুখমণ্ডলও তার একান্তই ব্যক্তিগত অঙ্গ হিসেবে বিবেচিত হয়। শিশুকে শেখাতে হবে যে, তাদের এসকল ব্যক্তিগত অঙ্গগুলো স্পর্শ করার অধিকার কারো নাই এমন কি সেও অন্যদের এসব অঙ্গ স্পর্শ করতে পারবে না। কেউ যদি স্পর্শ করেও তাহলে সে যেন অনতিবিলম্বে তার বাবা-মা বা আস্থাভাজন ও বিশ্বস্ত প্রাপ্তবয়স্ক লোকদেরকে তা জানিয়ে দেয়। তাদেরকে এটাও শেখাতে হবে যে, বড়রা বিশ্বাস না করা পর্যন্ত যেন তাদেরকে অভিযোগের বিষয়টি বারংবার বলে যেতে থাকে। শিশুদের বয়স আড়াই থেকে তিন বছর অতিক্রম হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বাবা-মা এর উচিৎ তাদেরকে এমন পাঁচ-ছয়জন আস্থাভাজন প্রাপ্তবয়স্ক লোকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়া যাদেরকে তারা নির্দ্বিধায় সম্পূর্ণরূপে বিশ্বাস করতে পারে। এসকল লোক নির্বাচনে বাবা-মা কে অধিকতর সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। শিশুকে বলে দিতে হবে কেউ যদি তাদের একান্ত ব্যক্তিগত অঙ্গগুলো দেখতে চায় বা স্পর্শ করতে চায় বা তার নিজের ব্যক্তিগত অঙ্গগুলো দেখাতে চায় বা কোন ছবি বা ভিডিও দেখাতে চায় তা ঠিক নয় বরং এমনটা ঘটলে তারা যেন বিশ্বস্ত ও আস্থাভাজন প্রাপ্তবয়স্ক লোকদের জানিয়ে দেয়।
শিশুদেরকে মানবিক ও মানসিক অনুভূতির বিষয়েও শিক্ষা দেয়া জরুরি, তাদেরকে শেখাতে হবে সুখ, দুঃখ, রাগ, উত্তেজিত হওয়ার অর্থ কি এবং কিভাবে এসকল অনুভূতি প্রকাশ করতে হয়। ‘নিরাপদ-অনিরাপদ’ বা ‘ভাল-খারাপ’ অনুভূতি বোধ করার বিষয়ও শেখাতে হবে। এসবের সাথে আবেগগত ভিন্নতা বা পার্থক্য রয়েছে তাও শিক্ষণ-শিখনের অন্তর্ভূক্ত থাকতে হবে। বুঝিয়ে দিতে হবে যে, নিরাপদ বোধ করলে বা ভাল কিছু হলে সুখের অনুভূতি হয় এবং শরীরে একধরনের উষ্ণতা বোধ হতে পারে, কিন্তু অনিরাপদ বোধ করলে বা খারাপ কিছু ঘটলে মনের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হতে পারে, পেটের ভেতর অস্বস্তি লাগতে পারে, অসুস্থ বোধ হতে পারে, হৃৎপিন্ডের বিট বা কম্পন বৃদ্ধি পেতে পারে, হাত কাঁপা বা হাতে ঘামের সৃষ্টি পেতে পারে, কান্না পেতে পারে আর এসবই নিরাপত্তাহীনতা বা ভয়ের কারণে ঘটে থাকে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে দ্রুত পরিবর্তনশীল আধুনিক প্রযুক্তির সহজলভ্যতায় চ্যালেঞ্জিং বিশ্বে টিকে থাকার জন্য শিশুদেরকে প্রয়োজনীয় দক্ষতায় সুদক্ষ হওয়ার সকল কৌশলগুলো অনতিবিলম্বে শেখাতে হবে।
শিশুরা ছবিযুক্ত বই পছন্দ করে বিধায় দেহের নিরাপত্তার স্বার্থে দৈহিক নিয়ন্ত্রণ এবং লিঙ্গ সমতা বিষয়ে ছবিযুক্ত বইয়ের মাধ্যমে তাদেরকে প্রশিক্ষিত করে তোলা যেতে পারে। একদিকে যেমন শিশুদেরকে প্রশিক্ষণ দিতে হবে অন্যদিকে তাদের বাবা-মাকেও দৈহিক নিরাপত্তার মতো বিষয়গুলো সম্পর্কে সুস্পস্ট ধারণা থাকতে হবে। বাবা-মাকে অবশ্যই অবশ্যই শিশুদের মানসিক বিকাশের যাবতীয় কৌশল সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করতে হবে। কোমলমতি শিশুটি যৌন নিগ্রহের শিকার হচ্ছে কিনা তা বোঝার মত অতন্দ্র পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা থাকতে হবে। শিশু যৌন নিপীড়িত হওয়ার কথা বললে বা ইঙ্গিত দিলে তা অগ্রাহ্য না করে বরং তা আমলে নেয়ার মানসিকতা থাকতে হবে কারণ বেশিরভাগ শিশুই এ বিষয়ে মিথ্যার আশ্রয় নেয় না।
আমরা সাধারণত: যখন দেখি একটা শিশু বা নারী যৌন নিগ্রহের শিকার হয়েছে বা লাঞ্চিত হয়েছে তখন কয়েকদিন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনা করে ভাইরাল করে ফেলি কয়েকদিন পর নিজেরাই ভুলে যাই অথচ নিগ্রহকারী এটা না ভুলে পরবর্তী শিকার এর সন্ধানে লিপ্ত থাকে। এটা বুঝতে চাই না যে, হাতেগোণা কয়েকটা খবরই প্রচার পায় বেশীরভাগই থেকে যায় অগোচরে বা অনেকেই প্রকাশ করতে লজ্জা পায়। কিন্তু থেমে থাকে না মানুষরূপী কিছু নিগ্রহকারী প্রণী। এর মূলে রয়েছে সমাজের মানুষের অন্যের বিপদে এগিয়ে আসার বিষয়ে অনীহা, সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হওয়ার ভীতি, দূর্বল মানসিকতা, পারিবারিক সুশিক্ষা ও যথাযথ মূল্যবোধের অভাব, আপাত প্রভাবশালীর যন্ত্রণা, ভিক্টিমের আইনী সহযোগিতার অভাব বা তা গ্রহণে অনীহা বা অজ্ঞতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের ঘাটতি, সতর্কতা ও সচেতনতার অভাব, অভিজ্ঞ কাউন্সিলর/পরামর্শদাতার অভাব, গোড়ামি, ঠুনকো লজ্জাবোধসহ হাজারো সমস্যা। সমাজের প্রতিটি স্তর থেকে যদি সম্মিলিতভাবে এর বিরুদ্ধে আওয়াজ উঠতো, এহেন ঘৃণ্য কাজ প্রতিহত করত এবং যথাযথভাবে বিদ্যমান আইনের বাস্তবায়ন প্রতিপালনসাপেক্ষে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা যায় তাহলে যৌন নিপীড়করা এত সহজে অপকর্ম করার সাহস পেত না বলে প্রতীয়মান হয়। তাই বাবা-মা’কেই সাবধান থাকতে হবে এবং নিজের সন্তানকে নিজেকেই রক্ষা করতে হবে এর কোন বিকল্প নাই।
বাবা-মা’কে পারিবারিকভাবেই নিম্নের বিষয়গুলি নিশ্চিত করতে হবে:
– শিশুরা যেহেতু প্রথম নির্যাতিত হয় কাছের মানুষ দ্বারা সেহেতু শুনতে ভালো না লাগলেও ভাই, চাচা, মামা, খালা, ফুফু, কিংবা কাজের লোকের নিকট বাচ্চা রাখা যাবে না বিশেষ করে বাচ্চা যখন একটু বড় হয়ে যায়। সন্তানকে কখনই কারো কোলে দেয়া বা কারও কোলে বসতে দেয়া বা তাকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে দেয়া সম্পূর্ণরূপে বারিত করতে হবে। ব্যস্ততম নাগরিক বা গ্রামীণ জীবনে অনেক সময়েই অনেক দূরের বা কাছের আত্মীয় স্বজন বাসায় বেড়াতে আসেন তখন অনেকেই জায়গার অভাবে সন্তানকে তাদের সাথে বিছানা ভাগাভাগি করতে বলেন এটা করা যাবে না। কেননা আত্মীয়টি যদি অমানুষ হয়ে থাকে তবে সে এ সুযোগটাই কাজে লাগাবে;
– শিশুদের সামনে কাপড় পাল্টানো যাবে না এবং শিশুদেরকেও শেখাতে হবে কাপড় পাল্টানোর নিয়ম ঘরের দরজা বন্ধ করে অন্যের সামনে নয়। মার্জিত পোষাক পরিচ্ছদ পরিধানের শিক্ষা দিতে হবে শিশুকে, ড্রেসকোড সম্পর্কে ধারণা দিতে হবে। এমন কি শিশুদের সামনে বাবা-মা কখনই বেশী অন্তরঙ্গ হবেন না কারণ এতে শিশুটি অল্পতেই সংবেদনশীল (Sensitized) হয়ে যেতে পারে। অনেক সময় দেখা যায় একজনের শিশু সন্তানকে আদর করে অন্যের ছেলের বউ বা মেয়ের জামাই বলে সম্বোধন করে, এটাকে প্রশ্রয় দেয়া যাবে না;
– শিশু সন্তান কোথাও খেলতে গেলে নজরে রাখতে হবে যে, সে কি ধরনের খেলা খেলছে, খেলার সঙ্গী কে, বড়দের সাথে খেলছে কি না, চোখের আড়ালে গিয়ে খেলছে কি না, বাবা-মা যদি দুপুরে ঘুমিয়ে থাকেন তখন সে খেলতে যাচ্ছে কি না বা তাকে কেউ ঐসময় ডেকে নিয়ে যাচ্ছে কি না ইত্যাদি। বাচ্চা বাইরে খেলতে যেতে চাইতেই পারে এমনকি মানসিক বিকাশের জন্য বাইরে পাঠাতে হয় সেক্ষেত্রে বাচ্চাকে দেখভাল করতে পারেন এমন বিস্বস্ত কাউকে দায়িত্ব দিতে হবে; কোন আত্বীয় বা বন্ধুর বাসায় শিশু সন্তানকে জোর জবরদস্তি করে পাঠানো যাবে না যেখানে সে স্বস্তি বোধ করে না বা যেতে চায় না বা এমন কারও কাছে পাঠানো যাবে না যার কাছে সে আগে যেতে পছন্দ করত কিন্তু এখন যেতে চায় না। বরং এক্ষেত্রে অনুসন্ধান করে মূল কারণ বের করা জরুরি;
– হঠাৎ দেখা গেল উচ্ছ্বল ও প্রাণবন্ত শিশুটি কেমন যেন খুব চুপচাপ হয়ে গেছে বা নিজেকে সব কিছু থেকেই গুটিয়ে নিচ্ছে তখন বাবা-মা’কে নিজ থেকেই এর কারণ চিহ্নিতকরণে এগিয়ে আসতে হবে সর্বাগ্রে এবং কৌশলে কারণ উদঘাটনের পাশাপাশি সন্তানকে বোঝাতে হবে বাবা-মা’ই তার সবচেয়ে আপনজন এবং তারাই তার সমস্যার সমাধানে সহযোগিতা করতে পারবেন অন্য কেউ নয়;
– টেলিভিশন বা যেকোন রিয়েলিটি শো বা কার্টুন বা সিনেমা বাচ্চাদের দেখানোর পূর্বে বাবা-মা’কে দেখে নিতে হবে তাতে আপত্তিকর বা অসামাজিক কিছু আছে কিনা। যদি থাকে তবে সন্তানকে তার ভাল-মন্দ দিক বুঝিয়ে তা দেখা থেকে দূরে রাখতে হবে। অনেক আপত্তিকর চ্যানেল আছে যা চালু থাকলে সন্তান কৌতুহলী হয়ে দেখতে চাইতে পারে সেসব চ্যানেল অবশ্যই বন্ধ রাখতে হবে, এমনকি বাবা-মা’ও নিজে দেখবেন না পাশাপাশি সন্তানকেও দেখতে দিবেন না। মনে রাখা প্রয়োজন নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি মানুষের কৌতুহল বেশী থাকে। অধিক সাবধান হতে হবে ইন্টারনেট ভিত্তিক পর্ন সাইটগুলোর বিষয়ে, এসকল সাইট ব্লক করে রাখা যেতে পারে। বাংলাদেশ সরকার অবশ্য এ বিষয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ নিয়ে সফল হয়েছে কিন্তু প্রক্সি সার্ভার ব্যবহার করে অনেক দুষ্টু লোক তা তাদের নিজের স্বার্থেই ব্যবহার করছে। তাই সন্তান কি ধরনের সাইট ভিজিট করে সে বিষয়ে নজর রাখা প্রয়োজন। অনেক সময় বাচ্চারা বিভিন্ন প্রাণীর আচরণ সম্বলিত ডিসকভারী চ্যানেল ভক্ত হয় যা দোষের নয় কিন্তু সে চ্যানেলে যদি পশুর যৌন কর্মকান্ড দেখানো হয় তবে বাচ্চার সংবেদণশীল হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়ে যায় যা ভবিষ্যতে বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য দায়ী হতে পারে, কোন জোর জবরদস্তি না করে শিশুকে এর ভালো মন্দ দিক বোঝাতে হবে। মনে রাখা জরুরি বাবা-মা শিশুর যৌন শিক্ষা বিষয়ে আসল শিক্ষক। যৌন শিক্ষা দিতে বাবা-মা’কেই সাবধানতার সাথে এগিয়ে আসতে হবে কারন তারাই তাকে গুরুত্বপূর্ন এ বিষয়ে যথাযথভাবে শিক্ষা দিতে পারবেন। সন্তানকে নৈতিক শিক্ষা দিতে হবে এটা হয়ত তাৎক্ষণিক বা একদিনে তা সম্ভব নয় কিন্তু ধীরে ধীরে দেয়া সম্ভব। এক্ষেত্রে বাবা-মা ব্যর্থ হলে সমাজই শিশুকে তা শেখাবে যা ভুল পথেও হতে পারে;
– শিশুকে বোঝাতে হবে কখনই যেন কাউকে সুযোগ না দেয় যৌনাঙ্গে হাত দিতে, এমনটা ঘটলে অবশ্যই যেন বাবা-মা’কে জানায়। পাশাপাশি তাকে শেখাতে হবে নিজের অঙ্গ নিজেকেই পরিস্কার রাখতে হবে অন্য কারও সহযোগিতা নেয়া যাবে না এবং বাবা-মা এর উচিৎ হবে না সন্তানের আড়াই থেকে তিন বছর বয়স হওয়ার পরে পিতা-মাতাও সন্তানের অঙ্গে হাত দিবেন না। চলার পথে ভিড়ের মাঝে অস্বস্তিকর বা খারাপ স্পর্শকে চিনতে সাহায্য করতে হবে, এ ধরনের স্পর্শ থেকে নিজেকে কিভাবে রক্ষা করা যায় তা সন্তানকে বলতে হবে। নিজেই নিজেকে বাচাঁনোর বা রক্ষা করার কৈাশল শেখাতে হবে।
– শিশুকে স্মার্ট ফোনের পরিবর্তে ফিচার ফোন দেয়া যেতে পারে জরুরি যোগাযোগের জন্য, সেইসাথে তাকে কিভাবে স্পিড ডায়াল ব্যবহার করতে হয় তাও শিখিয়ে দিতে হবে এবং স্পিড ডায়ালে জরুরি সেবা বা সহযোগিতা পাওয়ার সুবিধার্থে বিভিন্ন হট লাইন নম্বর সেভ করে দিতে হবে।
গ্রন্থপঞ্জি:
যৌন হয়রানি বা যৌন নিপীড়ন বিষয়ক লেখনীতে যে সকল বই, আর্টিকেল, জার্নাল, কলাম, বক্তব্য, বক্তৃতা ইত্যাদি আমাকে ভাবিয়েছে এবং এ সংশ্লেষে তথ্য, জ্ঞান ও উপস্থাপনে সমৃদ্ধ করেছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি সে সকল লেখকদের প্রতি।
www.armiah.com