©মোঃ আবদুর রহমান মিঞা (‘শেখ হাসিনা ইয়ুথ ভলান্টিয়ার অ্যাওয়ার্ড ২০২০’ পদকপ্রাপ্ত)
প্রথমেই দেখা যাক যৌন হয়রানি বা যৌন নিপীড়ন কি?
যৌন বিষয়ক অরূচিকর ও অশ্লীল কথা, অশ্লীল আকার ইঙ্গিত কিংবা শোভন কোন বিষয়কে দ্বৈত অর্থে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে উপস্থাপনপূর্বক কাউকে বিরক্ত করাই হলো যৌন হয়রানি। অপরদিকে অন্যের (বিপরীত বা একই লিঙ্গের) দ্বারা শরীরের ব্যক্তিগত বা গোপন অঙ্গে অযাচিত স্পর্শ বা আঘাত যৌন নিপীড়নের অন্তর্ভূক্ত। এক কথায় যৌন সংক্রান্ত অবাঞ্চিত আবদার বা জোর জবরদস্তিই যৌন হয়রানী বা যৌন নিপীড়ন। সেটি হতে পারে ছেলে মেয়েকে বা মেয়ে ছেলেকে বা মেয়ে মেয়েকে বা ছেলে ছেলেকে।
অনেক সময়ই সন্তানকে পারিবারিকভাবে যথাযথ যৌন শিক্ষা প্রদান না করা হলে সন্তানের বয়সন্ধিকালে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ ও যৌন বৈশিষ্ট্যের কারণে এবং তা নিয়ন্ত্রণের উপায় জানা না থাকায় বিপদজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে ফেলে। যেকোন সমাজেই যদি সঠিক জ্ঞানের ঘাটতি থাকে বা পারস্পরিক সৌহার্দ্য বোধ বা পারস্পরিক সম্মাণ ও শ্রদ্ধার দৃষ্টিভঙ্গিতে জটিলতা থাকে বা সুশিক্ষায় শিক্ষিত না হয়ে স্বশিক্ষায় শিক্ষিত লোকের সংখ্যা বেশি হয় তবে এধরনের হয়রানি বা নিপীড়ন ঘটে থাকে তন্মধ্যে তুলনামূলকভাবে সাধারণত মেয়েরাই বেশি যৌন হয়রানি বা নিপীড়নের শিকার হয়। কারও অসম্মতির বিরুদ্ধে যৌন আবেদনই যে যৌন হয়রানি বা নিপীড়ন সেটাই অনেকে বুঝেন না বা বুঝতে চান না, এটি স্বামী-স্ত্রীর বেলায়ও সমভাবে প্রযোজ্য অর্থাৎ ইচ্ছার বিরুদ্ধে এমনটা করার সুযোগ নাই। গবেষণা বলে যৌন হয়রানির শিকার হননি এরকম মেয়ের সংখ্যা পৃথিবীতে অপ্রতুল। কোন ঘটনা প্রকাশ পায় কোনটা পায় না। অনেক সময় হয়ত যৌন হয়রানি যে হচ্ছে সেটাই ভুক্তভোগী বুঝেন না। মানুষ সামাজিক জীব এবং বেশিরভাগই বন্ধুবৎসল তাই স্ব স্ব কৃষ্টি ও সংস্কৃতি অনুযায়ী বিভিন্ন পার্বনে বা জাকজমক বিয়ের অনুষ্ঠানে বোনের স্বামী বা স্বামীর পক্ষের বন্ধু বান্ধব বা তার কাজিন বা বেয়াই/বেয়াইন হাসির ছলে আজে বাজে ইঙ্গিত করবে বা গায়ে হাত দিয়ে বা স্পর্শকাতর জায়গা নির্দেশ করে কথা বলবে এটাই যেন ভবিতব্য বা স্বাভাবিক বিষয়। কেউ বুঝতেই চান না যৌন হয়রানি বা যৌন নিপীড়ন শুরুই হয় পরিবার থেকে এবং কাছের লোক থেকেই, বিধায় এক্ষেত্রে আরও বেশি সতর্ক হওয়া সময়ের দাবী।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নারী নির্যাতন বিষয়ক প্রতিবেদন অনুযায়ী বিশ্বের প্রায় এক তৃতীয়াংশ নারী যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। এ সংস্থার উপাত্ত ও তথ্যানুয়ী বিশ্বের মোট নারীর সাত শতাংশই জীবনের কোন না কোন পর্যায়ে ধর্ষনের শিকার হয়েছেন। সুশিক্ষার অভাবে দিনকে দিন ইভটিজিং বা যৌন নিপীড়নের ঘটনা ঘটেই চলেছে, এর যেন শেষ নেই। একের পর এক ধর্ষন, যৌন আক্রমন এবং নিপীড়ন ও নির্যাতন পশুকে হার মানাচ্ছে কতিপয় মানুষরূপী ভয়ংকর জীব। নারীরা আজ সকল কাজে এগিয়ে আসছেন এবং তাদের যোগ্যতা ও দক্ষতার নিদর্শন রেখে চলেছেন কিন্তু কিছু লোলুপ দৃষ্টি প্রতিনিয়তই তাদের দেহের বিভিন্ন গঠনের উপর সর্বদাই সচল দৃষ্টি রেখে বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে। এই লোলুপ দৃষ্টি এতটাই মানসিক বিকারগ্রস্ত যে, যার উপর দৃষ্টি দিচ্ছে তার বয়স কত সে শিশু না বৃদ্ধ না কিশোরী না যুবতী কিংবা তার সাথে সম্পর্কটাই বা কি কোনকিছুই বিবেচ্য নয়। বাসা-বাড়ীতে, রাস্তায়, যানবাহনে, মার্কেটে, কর্মস্থলে এমন কি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কমবেশী এধরনের সংবাদ পত্রিকায় আসছে বা কোনটা আসছে না।
শিশুর যৌন নিপীড়ন ঠেকাতে আইনের পাশাপাশি শিশুদের সুরক্ষা দিতে প্রয়োজন পারিবারিকভাবে জনসচেতনতা। বর্তমান সময়ে কেন জানি মানুষের মানবীয় গুণাবলিতে ঘাটতি দেখা দিচ্ছে, মানবীয় গুণাবলীর চর্চার প্রয়োজন নিয়মিত যা পশুত্বকে নিয়ন্ত্রণ করে বিকাশ ঘটাবে মনুষত্বের। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবকালীন আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির যুগে যথাযথ জ্ঞান থাকা প্রয়োজন ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এর উপর, শুধু জ্ঞান থাকলেই হবে না সচেতন হতে হবে এর সুবিধা অসুবিধাগুলোর বিষয়েও যেন এসকল প্রযুক্তির অপপ্রয়োগ না ঘটে। পাশাপাশি শিশুদের নিজেকে রক্ষা করার বা আত্মরক্ষার কৌশল শেখানো প্রতিটি বাবা-মা বা আস্থাভাজন অভিভাবকের গুরুত্বপূর্ণ একটি দায়িত্ব। গণমাধ্যমগুলি এবিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে বৃহত স্বার্থে। সকলের সম্মিলিত এবং সমন্বিত প্রচেষ্টাই পারে শিশুদের জন্য একটি নিরাপদ এবং সুন্দর টেকসই সমাজ উপহার দিতে যেখান থেকে তৈরি হবে নীতি নৈতিকতাপূর্ণ উন্নত চরিত্রের মানবীয় গুণসম্পন্ন নাগরিক।
যৌন হয়রানি, ইভটিজিং, ধর্ষণ ও যৌন নিপীড়নের ব্যাপারে স্বাভাবিকভাবেই বেশী উদ্বিগ্ন থাকেন বাবা-মা। কীভাবে রক্ষা করবেন সন্তানকে? এর থেকে কি উত্তরণের কোন উপায় নাই? যদি থাকে তবে সেটা কিভাবে? এসকল প্রশ্নের জবাব পেতে হলে আরও অনেক প্রশ্নের সদুত্তর খোঁজা জরুরি সেখান থেকে পাওয়া যাবে সমাধান। দেখা যাক সেগুলো কি এবং কি তার সমাধান।
যৌন নিপীড়ন কী? কেন নিপীড়িত হয়? এর মনো-সামাজিক তথা মনস্তাত্বিক কি কারণ নিহিত থাকতে পারে?
যৌন হয়রানি এবং শরীরের অবাঞ্ছিত স্থানে অনধিকার চর্চা বা অযাচিত স্পর্শ, পাশাপাশি জোর জবরদস্তির মাধ্যমে বা ব্লাকমেইল করে যৌন কর্মকাণ্ডের চেষ্টা করা বা কর্মকান্ড ঘটানোকেই সাধারণভাবে যৌন নিপীড়ন বলা হয়ে থাকে। অর্থাৎ কারো ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোরপূর্বক যৌন কার্যকলাপ বা যৌন জিঘাংসায় লিপ্ত হওয়ার বা বাস্তবায়নের অভিপ্রায়কেই বলা হয় যৌন নিপীড়ন।
বর্তমানে যথাযথ পারিবারিক, সামাজিক, মানসিক ও চারিত্রিক মূল্যবোধের গড়মিল এতটাই বিদ্যমান যে, দুই বছরের বা তদনিম্ন বয়সের কোমলমতি শিশুও এ নিপীড়নের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না।
বেশিরভাগ মেয়ে শিশু, কিশোরী, যুবতি, প্রৌঢ় ইভটিজিং এবং নানা ধরনের যৌন হয়রানি বা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। যৌন হয়রানি প্রতিরোধ করতে গিয়ে যৌন হয়রানিকারীদের হাতে মারধরেরও শিকার হচ্ছে শিশু৷ বাস্তবে শিশুদের যৌন নিপীড়নের অনেক ঘটনা সামাজিক ও পারিবারিক বিভিন্ন কারণে প্রকাশ পায় না৷ সাধারণত বাংলাদেশে নিম্নবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের শিশুই যৌন নিপীড়নের শিকার বেশি হয়। যারা বস্তিতে বা ছিন্নমূল হিসেবে বসবাস করে তাদের পারিবারিক সুরক্ষা নেই বললে অত্যুক্তি হবে না। যারা শিশু যৌন নিপীড়ক বা নির্যাতনকারী তাদের একটা বড় অংশই একই পরিবেশের বাসিন্দা এবং ঐ বাস্তবতায় তারা প্রভাবশালীও বটে।
ভারতের একটা টিভি বিজ্ঞাপনে দেখা যায় মাধুরী দীক্ষিত বলছেন,
“बचपन से ही शिखाते है की लड़के रो ते नेही, शायद बेहतर होगा अगर हम शिखाये लड़के रोलते नहीं”।
(বাংলায় উচ্চারণ: “বাচপান সে হি শিখাতে হ্যায় কি লাড়কে রো তে নেহি, শায়েদ বেহতার হোগা আগার হাম শিখায়ে লাড়কে রোলাতে নেহি”)
এর বাংলা অর্থ, “ছোটবেলা থেকে শেখানো হয় ছেলেদের কাঁদতে নেই, বরং ভালো হতো আমরা যদি ছেলেদের শেখাতে পারতাম কাউকে কাঁদাতে নেই”।
মনোরোগ চিকিৎসক, সমাজ ও জেন্ডার বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে, বাংলাদেশের চিত্র ভারতের চেয়ে খুব একটা ভিন্ন নয়। বাংলাদেশের পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা ছোটবেলা থেকে ছেলে শিশুদের মনে বীজ রোপণ করে দেয় যে, তারা শক্তিতে মেয়েদের চাইতে অগ্রগামী এবং নিরাপদ কিন্তু কোনো ছেলে যেন মেয়েদের নিরাপত্তাহীনতার কারণ বা অনুঘটক না হয় সে বিষয়ে পারিবারিকভাবে কোনো সুশিক্ষা প্রদান করা হয় না। এছাড়াও বিভিন্ন গবেষণায় বিশেষজ্ঞগণ দেখিয়েছেন যে, যেসব পরিবারে ছেলে শিশু তার শৈশবে বা কৈশোরে যৌন নিপীড়নের শিকার হয় অথবা যারা দেখে পরিবারের মেয়ে শিশুটি যৌন নিপীড়ন বা নির্যাতনের শিকার হওয়ার পরও পরিবারের বড়রা তাদের চুপ করে থাকার পরামর্শ দিচ্ছে বা আইনের আশ্রয় নিচ্ছেন না বা বিষয়টি গোপন করে যাচ্ছেন কিংবা ছেলেদের অপরাধকে ছোট করে দেখা হচ্ছে সেসব পরিবারের ছেলে শিশু কালের পরিক্রমায় যৌন নিপীড়ক বা নির্যাতনকারী হয়ে উঠছে। এমন পরিবারে গড়ে ওঠা ছেলেরা যৌন নিপীড়নকে অপরাধ বলেই গণ্য করে না। বেশিরভাগ মানুষই নিপীড়িত মেয়েকে বা নারীকেই দায়ী করে থাকে দায়ী করা হয় তার চালচলন, পোশাক-আশাক ইত্যাদিকে এসবের প্রভাব পড়ে শিশুর মনের উপর যার প্রকাশ ঘটতে শুরু করে তার কৈশোর থেকেই। শিশুর মনোজগতে বাবা বা বড় ভাই বা অভিভাবক পুরুষটির বৈশিষ্ট্যই বেশি প্রভাব বিস্তার করে এবং অবচেতন মন সেভাবেই তাকে পরিচালিত করে থাকে। যে পরিবারে বাবা তাঁর সিদ্ধান্ত পরিবারের অন্য সদস্যদের উপর চাপিয়ে দেন, পরিবারের নারী সদস্যদের হেয় প্রতিপন্ন করেন, পরিবারের সদস্যদের নির্যাতন করেন কিংবা অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পরেন সে পরিবারের শিশুটি বড় হয়ে বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করতেই পারে বা বাবার কৃতকলাপ শিশুর মধ্যে প্রেষণার উদ্রেককারী হওয়া আশ্চর্যজনক কিছু না, তাই ভবিষ্যত গঠণে পরিবারের সমন্বয়ের বিকল্প নাই।
পরিবারের পাশাপাশি সমাজেরও ভূমিকা রয়েছে। পরিবার থেকে পিতৃতান্ত্রিকতার প্রচণ্ড প্রভাব দেখে যারা অভ্যস্ত তারা বাড়ির বাইরে একই রকম পিয়ার গ্রুপ বা সঙ্গী খুঁজে নেয়। এরা একসঙ্গে মাদক সেবন করছে, পর্নোমুভি বা অশ্লীল ছবি দেখছে বা বিকৃত আনন্দে মেতে উঠছে মনের মধ্যে ফ্যান্টাসি বা অবাস্তব কল্পনার জগৎ সৃষ্টি করছে। এদের মধ্যেই গণধর্ষণের প্রবৃত্তি জাগ্রত হয় এবং অন্যকে কষ্ট দিয়ে আনন্দ পায়। এদের কাছে মনেই হয় না যে এগুলো অপরাধ, বেশিরভাগই লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহবোধ করে না বরং নিজের নায়কোচিত আচরণে লিপ্ত থাকে এক্ষেত্রে অনেক বাবা-মা বা পরিবার আরও একটু উস্কানি দেয় প্রয়োজনের বাইরে আধুনিক ফোন, মটর সাইকেল ইত্যাদি উপহার দিয়ে। বেশিরভাগ বাবা-মা যতটা না আগ্রহী এসব উপঢৌকন দিতে ঠিক ততটাই অনাগ্রহ সন্তানের মধ্যে পারিবারিক বা সামাজিক মূল্যবোধ তৈরিতে। অনেকেই বলে থাকেন মেয়েরা যদি শালীনভাবে চলে বা পোশাক পরিচ্ছদ মার্জিতভাবে পরিধান করে তবে এমনটা হওয়ার কথা নয় বিষয়টি একদম উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায় যে, তাহলে যে সকল মেয়েরা হিজাব বা বোরকা পরিধান করে চলাফেরা করে তারা কেন এ ধরনের নিপীড়নের শিকার হয়? এ জায়গাটিতেই পারিবারিকভাবে মূল্যবোধ তৈরির প্রয়াস পায়। আর একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, যারা অন্যায় করছে তারা সমাজের ক্ষমতাধর পরিবারের সন্তান বা তাদের ছত্রছায়ায় গড়ে ওঠা কিছু বিকৃত মানসিকতার মানুষরূপী প্রাণী। বাংলাদেশের বেশির ভাগ পুরুষই যৌন নিপীড়ন বা নির্যাতন করেন না কিন্তু অনেকেই করেন এবং একটি বড় অংশ চুপ থাকেন কোন প্রতিবাদ করেন না মান সম্মাণ হারানোর ভয়ে বা ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে। বিষয়টি এমন যেন নারীরা নিপীড়নের শিকার হবেন এবং চুপ করে থাকবেন কোন প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ করা যাবে না এটাই ভবিতব্য এবং এ ধারণাই সমাজে প্রতিষ্ঠা পেয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের সরকার যখন বিভিন্ন আইন, বিধি, বিধান, নীতি এবং নির্দেশনা দিয়ে সুশিক্ষা নিশ্চিতপূর্বক কর্মক্ষেত্রে নারীদের এগিয়ে নিতে আগ্রহী ঠিক তখন কিছু পুরাতন ধ্যান ধারণার বা গোড়ামির পুরুষ নারীর এই অগ্রগতি সহ্য করতে অপ্রস্তুত। তাদের ধারণা নারীর ক্ষমতায়ন মানেই পুরুষের ক্ষমতা কমে হ্রাস পাওয়া। এটা শুধু তাদের ধারণায় সীমাবদ্ধ থাকলেও হত কিন্তু তা নয় বিভিন্ন সামাজিক আচার অনুষ্ঠানেও তারা বিদ্রুপাত্মকভাবে উপস্থান করছেন এবং দিনকে দিন আক্রমণাত্মক হয়ে উঠছেন।
সঠিক বয়সে পারিবারিকভাবে যথাযথ যৌন সুশিক্ষা না পাওয়ার কারণে ছেলেদের একটি বড় অংশের মধ্যে বিকৃত ধ্যানধারণা তৈরি হচ্ছে। আপাতদৃষ্টিতে শান্ত ও ভদ্র ছেলেরাও সুযোগ পেলে মেয়েদের হয়রানি করে। এক্ষেত্রে বাবা-মা এর উচিৎ ছিল পারিবারিকভাবে যে বয়সে যতটুকু যৌন শিক্ষা দেওয়া দরকার ততটুকু শিক্ষা দেয়া।
বিখ্যাত নিউরোলোজিস্ট এবং পরবর্তীতে মনোবিজ্ঞানী ফ্রয়েড এর তত্ত্বানুযায়ী যাকে আমরা মন বলি তা মূলত তিনটি স্বত্ত্বার সমন্বয়ে গঠিত – ইড, ইগো এবং সুপার ইগো।
অর্থাৎ মানব মন এ তিনটি গাঠনিক উপাদানে বা স্বত্ত্বায় তৈরি –
– ‘ইড’ মূলত মানুষের জৈবিক স্বত্ত্বা। মানব মনের স্বভাবজাত চাহিদা পূরণ করে ইড। এটাকে ‘মন যা চায় তা’ এর সাথে তুলনা করা যায়। ‘ইড’ মানুষ এবং পশু সবার মাঝেই সমভাবে বিরাজমান। এর কোন মানবিক দিক বা বিকাশ নাই। ‘ইড’ লোভ, লালসা ও কাম চিন্তায় পূর্ণ। ‘ইড’ এমনভাবে মানুষকে প্ররোচিত করে যে মানুষ যে কোন অসামাজিক অপরাধ থেকে শুরু করে, খুন, ধর্ষণ ইত্যাদি সংঘটনে দ্বিধান্বিত হয় না। এক কথায় বলা যায় ‘ইড’ হচ্ছে মানুষের ভিতরকার ঘুমন্ত পশু।
– সুপার ইগো হচ্ছে মানুষের বিবেক। ইড যখন জৈবিক কামনা-বাসনা পুরণ করতে উদ্দীপ্ত করে, তখন সুপার ইগো একে বাঁধা দেয়। সুপার ইগো সব সময় মানুষের মানসিক দূর্বলতাকে অগ্রাহ্য করে ভাল কাজ করার জন্য উদ্দীপ্ত করে। এ বাঁধা দেওয়ার ক্ষমতা পুরোপুরি নির্ভর করে ব্যক্তির নৈতিক, চারিত্রিক, পারিবারিক, প্রাতিষ্ঠানিক এবং সামাজিক শিক্ষা ও মুল্যবোধের উপর।
– অন্যদিকে ইগো হচ্ছে এ দুই অবস্থার মধ্যে ভারসাম্য সৃষ্টিকারী একটি অবস্থা। ইগো এবং সুপার ইগোর মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে পরিচালনা করাই এর কাজ।
পশু ‘ইড’ চালিত তাই তারা কেবল জৈবিক চাহিদা (খাবার এবং যৌনতা) পূরণেই ব্যস্ত থাকে। মানুষের মধ্যে যখন ‘ইড’ প্রাধান্য পায় তখন সে উন্মাদ ও অমানুষ হয়ে যায় কোন হিতাহিত জ্ঞান থাকে না বা কাজ করে না। অপরদিকে যখন কেবলমাত্র ‘সুপার ইগো’ কাজ করে তখন সে সাধু সন্যাসীতে পরিণত হয়ে যায়। ‘ইগো’ এই দুই অবস্থার মধ্যে সমঝোতার মাধ্যমে সুন্দর ভারসাম্য রক্ষা করে চলে।
ইড বিষয়টি বিচেনায় নিলে জীব হিসেবে মানুষের সাথে অন্য প্রাণীর তেমন বেশি পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় না। উভয়েরই ইড আছে কিন্তু মানুষের এর সাথে অতিরিক্ত দু’টি স্বত্ত্বা আছে ইগো এবং সুপার ইগো।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে,
– মেয়েটি সুন্দরী, অতএব ওকে ইভটিজিং বা রেইপ করা যায় (ইড);
– রেইপ বা ইভটিজিং অপরাধ অতএব করা যাবে না (সুপার ইগো);
– মেয়েটির সাথে বন্ধুত্ব করার চেষ্টা করা, তাকে শ্রদ্ধার চোখে দেখা বা তার প্রাপ্য সম্মাণটুকু দেয়া বা তার কাজে সহযোগিতা করা ইত্যাদির মাধ্যমে কোনরকম জোর জবরদস্তি না করে শোভন আচরণের বহিঃপ্রকাশের মাধ্যমে হয়ত তার ভালবাসা পাওয়া যেতে পারে (ইগো)।
যারা বলেন মেয়েদের চলাফেরা বা পোশাক পরিচ্ছদ যৌন নির্যাতন বা নিপীড়নের জন্য দায়ী তাদের বক্তব্য সর্বৈব সত্য বলে মানার সুযোগ দেখছি না, কেননা একটি তিন বছরের মেয়ে বা হিজাব ও বোরকা পরিহিতা মেয়ে কিংবা ষাট বছরের বৃদ্ধা স্বাভাবিকভাবেই সে প্রেক্ষাপটে কোনরকম যৌনানুভুতি সৃষ্টি করার কথা না। কিন্তু শিখন পদ্ধতির যথার্থতার অভাবে একজন যৌন নিপীড়কের বা নির্যাতনকারীর মস্তিষ্কে যৌনানুভুতি মারাত্মক উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে যা বাড়িয়ে দেয় ‘ইড’ এর প্রতিনিধিত্ব করার ক্ষমতা এবং দূর্বল করে দেয় ‘সুপার ইগো’-কে ফলে ‘ইগো’ তার কর্মক্ষমতা হারায়। ইড, ইগো এবং সুপার ইগো এর আপেক্ষিক তীব্রতা স্থিতিশীল নয় এটা পারিপার্শ্বিকতার সাথে পরিবর্তনীয় যা পুরোপুরি নির্ভর করে পারিবারিক শিক্ষা ও উন্নত মূল্যবোধ এবং সামাজিক পরিবেশের উপর।
যৌন হয়রানি বা যৌন নিপীড়নে আক্রান্ত হয় কারা এবং কিভাবে? কাদের দ্বারা আক্রান্ত হয়? যৌন নিপীড়নের ক্ষতিকর দিক কি? এটা কি ট্রমা সৃষ্টিকারী?
যৌন হয়রানি বা যৌন নিপীড়নে আক্রান্ত হয় কারা এবং কিভাবে?
ছেলে শিশু বা মেয়ে শিশু, কিশোর বা কিশোরী, ছেলে বা মেয়ে, নারী বা পুরুষ বয়ঃবৃদ্ধ নির্বিশেষে যে কেউ যৌন হয়রানি বা নিপীড়নের শিকার হতে পারেন। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নারী, কন্যা শিশু এবং ছেলে শিশুরাই এমন অভিজ্ঞতা অর্জন করে। ঠিক কখন কে কিভাবে এ ধরনের হয়রানি বা নিপীড়নের শিকার হবে বলা মুস্কিল, এটা সম্পূর্ণ নির্ভর করে আক্রমণকারীর বিকৃত মানসিকতার উপর।
একজন মানব সন্তান অপর একজন মনুষ্য আকৃতির প্রাণী দ্বারা বিভিন্নভাবেই যৌন হয়রানি বা যৌন নিপীড়নের শিকার হতে পারে। যেমনঃ
ক) আক্রমণকারীর শারীরিক শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে বা জোর জবরদস্তির মাধ্যমে;
খ) দুশ্চরিত্রধারী কর্তৃক লোভ দেখিয়ে বা কোনো ফাঁদে ফেলে অথবা দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে;
গ) কারো সরলতা বা অসতর্কতা বা অসচেতনতার সুযোগ নিয়ে।
কন্যা এবং ছেলে শিশুরা খুব সহজেই যৌন নিপীড়নের শিকার হয় কেননা তারা সহজে যৌন উৎপীড়ককে বাঁধা দিতে পারে না। এমন কি তারা সহজেই বুঝে উঠতে পারে না কে কোন মানসিকতার। শিশুরা তাদের আশেপাশের আত্মীয়স্বজন এবং পরিচিতজনদের দ্বারাই ব্যাপকভাবে নিগৃহীত হয়ে থাকে। সাধারণতঃ পরিবারে এমন কিছু সদস্য থাকে যাদের কখনোই মনে হয় না যে তারা সন্তানের জন্য ক্ষতিকর অথচ এদের মাধ্যমেই কোমলমতি শিশুরা বেশি নির্যাতিত বা নিগৃহীত হয়ে থাকে। অনেক সময় শিশুরা এদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলে বা কিছু বললেও অনভিজ্ঞতার কারণে বড়রা তাদের কথা এড়িয়ে যায় বা হেসে উড়িয়ে দেয়।
শিশুদের সাথে সাথে বড় অংশের নারীরাও যৌন নিপীড়নের শিকার হয়। বিশেষ করে দরিদ্র নারী বা যেসব নারীর প্রকৃত স্বাধীনতা নাই বা যারা অন্যের উপর নির্ভরশীল বা অন্যের ইচ্ছা-অনিচ্ছা দ্বারা পরিচালিত হয় তারাই বেশি ভুক্তভোগী হয়। পাশাপাশি কর্মস্থলেও তাদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে কিছু উৎপীড়কের দ্বারা যৌন নিপীড়নের শিকার হয়। শুধু তাই নয়, সমাজের উচ্চ শ্রেণীর নারীরাও কম-বেশি যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। বর্তমান বিশ্বায়নের আধুনিক প্রযুক্তির যুগে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর অপব্যবহারের কারণেও কিশোরী, নারী ও শিশু যৌন হয়রানি বা নিপীড়নের শিকার হচ্ছে। অনেকক্ষেত্রে কোনো দুর্বল বা স্পর্শকাতর ঘটনার সুযোগ নিয়ে নারীদের ব্ল্যাকমেইলের কারণেও যৌন নিপীড়নের শিকার হতে হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ফাঁদে ফেলে বা আইডি হ্যাক করেও যৌন হয়রানি বা নিপীড়ন বা অপদস্থ করা হয় নারীদের।
কাদের দ্বারা আক্রান্ত হয়?
পরিবারকে ঘিরে কিছু সদস্যই থাকে যারা বিকৃত চরিত্রের অধিকারী এবং সুযোগ সন্ধানী হয়ে থাকে যারা ছোট ছোট শিশুদেরকে লক্ষ্য করে অস্বাভাবিক রুচির অভিলাষ পূর্ণ করে থাকেন। এ ধরনের আত্মীয়স্বজন বা পরিচিতজন শিশুদের কথার ফাঁদে বিভিন্ন প্রলোভন এবং ভয়ভীতি দেখিয়ে জোরপূর্বক যৌন নিপীড়ন করে। পরিবারে কিছু সদস্য থাকেন, সমাজ যাদের সঙ্গে হাসি ঠাট্টার সম্পর্ক তৈরি করে রেখেছে। এইসব ভগ্নিপতি বা দুলাভাই (যারা বলেই থাকেন শালী আধি ঘরওয়ালী) বা দাদা সম্পর্কীয় সদস্যরাও অনেকক্ষেত্রে যৌন নিপীড়ন করার সুযোগ গ্রহণ করে থাকে এবং পরিবার মেয়ের সংসার টিকিয়ে রাখার জন্য চুপ থাকে বা হাসি-ঠাট্টার আবরণে অগ্রাহ্য করে। এছাড়াও আদর-স্নেহ দেয়ার নাম করে চাচা, জ্যাঠা, মামা, খালু, ফুফা ইত্যাদি সম্পর্কীয় আত্মীয় স্বজনরা সুযোগ নিয়ে থাকে এবং কৌশলে কোমলমতি শিশুদের নিজের বিকৃত যৌন জিঘাংসা পূরণে ব্যবহার করে।
ছেলে শিশুরা অনেক সময়েই শিক্ষক এবং আশেপাশের আপাত ভদ্র মধ্যবয়স্কদের দ্বারা আক্রান্ত হয়। ছেলেরাও যে যৌন হয়রানির শিকার হয় বা হতে পারে তা অনেকেই জানে না বা বুঝেন না বা বুঝতেই চান না। কোমল বা দুর্বল মানসিকতার নারীরা ঘরে স্বামী বা পরিবারের বিকৃতমনা সদস্য দ্বারা এবং কর্মক্ষেত্রে সহকর্মী দ্বারা আক্রান্ত হয়ে থাকেন। এছাড়াও ব্যস্ত নাগরিক জীবনে প্রতিনিয়ত রাস্তাঘাটে চলার সময় গণপরিবহনেও নারী, কিশোরী ও শিশুরা যৌন নিপীড়িত হন। মেয়েরা বিদ্যাপীঠের আশেপাশের বখাটের দ্বারা নিগৃহীত হন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিছু কুরুচিপূর্ণ ও বিকৃত মানসিকতার ব্যক্তি দ্বারাও নারী ও শিশু ভার্চুয়াল বা অনলাইন যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন। সর্বোপরি ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় কাজ করতে আসা উঠতি মডেল বা তারকারাও তাদেরই স্বগোত্রীয় পেশাজীবীদের হাতে কখনও কখনও যৌন নিপীড়নের শিকার হয়।
যৌন নিপীড়নের ক্ষতিকর দিক কি? এটা কি ট্রমা সৃষ্টিকারী?
বেশিরভাগ শিশু এবং নারী যৌন নিপীড়নের ভয়াল থাবার শিকার হলে ভবিষ্যৎ জীবনে শারীরিক ও মানসিক অসুস্থতায় ভোগে। শিশুরা নিজেদের জীবন যথাযথভাবে বিকশিত করতে ব্যর্থ হয়। ছেলে শিশুরা যৌন নিপীড়িত হলে তা তাদের মনের উপর খুব খারাপ প্রভাব বিস্তার করে এবং পরবর্তী জীবনে তারাও এক ধরনের যৌন নিপীড়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার শংকা থেকে যায়। একজন বিকৃত মনার লোক বারবার যৌন নিপীড়নের সুযোগ নিতে নিতে এবং শাস্তি না পেলে কালের প্ররিক্রমায় ওইসব নিপীড়কদের সাহস বেড়ে যায় এবং ধর্ষণের ন্যায় চরম ঘৃণ্য কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে কুশিক্ষা বা অবাঞ্চিত স্বশিক্ষায় অনুপ্রাণিত ব্যক্তিবর্গ বা বখাটেগণ যৌন নিপীড়নের মাত্রা বাড়িয়েই চলেছে যার থেকে শিশু বা বৃদ্ধাও নির্যাতন বা নিপীড়ন বা ধর্ষণ এর শিকার হচ্ছে।
যৌন নিপীড়নের শিকার হওয়ার কারণে অনেক ভুক্তভোগী পরবর্তী সময়ে আত্মহত্যায় উদ্ভূত হয়। বেশিরভাগ আত্মহত্যার মূলে প্রভাবক হিসেবে কাজ করে যৌন নিপীড়ন বা যৌন নির্যাতনের মত ঘটনা। ভিক্টিম অনেক সময় নিজ থেকে সুস্থ হতে চাইলে বা স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করলেও সমাজের কিছু অবাঞ্চিত লোকের লাঞ্চনার শিকার হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার পথ হারিয়ে ফেলে। অনেক কোমলমতি শিশুর জীবন শুরু হওয়ার পূর্বেই ঝড়ে যায়। এমন পরিস্থিতির শিকার শিশু এবং নারীরা পরবর্তী জীবনে মানসিকভাবে সুস্থ জীবনযাপন করতে ব্যর্থ হয় এবং মানসিক ট্রমায় আক্রান্ত হয়ে পড়ে৷ ট্রমা এতটাই গভীর হয় যে, তারা বাবা-ভাইকে দেখলেও আতংকিত হয় উপরন্তু কোনো স্থান বা সময় বা পোশাকের প্রতিও তাদের ভীতির সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
শিশুর আচরণ থেকে কি বুঝা যায় যে, সে নির্যাতিত বা নিপীড়িত হয়েছে কি না? যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধ বা প্রতিহতকরণে করণীয় কি? এর কৌশলগুলোই বা কি? পরিবারের ভূমিকা কি?
শিশুরা সাধারণত যৌন নিপীড়নের শিকার হলে তা সঠিকভাবে প্রকাশ করতে পারে না৷ তবে তাদের দৈনন্দিন আচরণের পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করলে মা-বাবা অথবা পরিবারের আস্থাভাজন সদস্যরা তা চিহ্নিত করতে পারেন। যেমন: শিশু বিশেষ কোন ব্যক্তিকে দেখলে ভীত হয়ে পড়ে বা তার উপস্থিতিতে নিজেকে লুকানোর চেষ্টা করতে পারে পূর্বে হয়ত তার কাছে যেত, বিশেষ কোনো বাসা বা বাড়ীতে যেতে না চাইতে পারে, বিশেষ কোনো স্থানকে ভয় পেতে পারে, কোনো শিশু হয়ত অন্য সময়ে বিছানায় প্রস্রাব করত না কিন্তু হঠাৎ করে বিছানায় প্রস্রাব করা শুরু করতে পারে, কোনো ব্যক্তিগত বিশেষ অঙ্গে ব্যাথার কথা বলতে পারে, ঘুমের মধ্যে হঠাৎ চিৎকার করে উঠতে পারে, অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করতে পারে, অশ্লীল শব্দ ব্যবহার করতে পারে যা পরিবার থেকে শেখানো হয় নাই ইত্যাদি৷ মা-বাবাকে এসব বিষয়সমূহ সতর্কতার সাথে খেয়াল করতে হবে বা নিগূঢ়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে জানতে সচেষ্ট থাকতে হবে। সেইসাথে শিশুর প্রতি পরিচিতজন বা আত্মীয়স্বজন কেমন আচরণ করে, তাদের আচরণে সন্দেজনক কোন কিছু পরিলক্ষিত হয় কি না সেটা ভদ্রোচিতভাবে বিশ্লেষণ করতে হবে। এমন কারুর কাছে শিশুকে রাখা যাবে না, যার মাধ্যমে শিশুর যৌন হয়রানির শিকার হওয়ার আশঙ্কা আছে। তার স্কুল, তার খেলার জায়গা, তার বেড়ানোর জায়গায় যেসব আশঙ্কা আছে, সেসব সম্পর্কে তাকে কৌশলে সচেতন করতে হবে। পরিবারের বা আশেপাশের আত্মীয়স্বজনরা কে কেমন রুচির অধিকারী তা জানার চেষ্টা করা। শিশুদের কারো প্রতি কোনো অভিযোগ থাকলে তা আগ্রহ নিয়ে শোনা এবং প্রয়োজনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
সন্তান বড় হলে সতর্ক করা যায়, বলা যায় বা বোঝানো যায় কিন্তু ছোট শিশুদের বলা বা বোঝানো দুষ্কর। জোর করে বোঝাতে গেলে ভালোর চাইতে খারাপ হতে পারে। এক্ষেত্রে পারিবারিক সুস্থ সুরক্ষা সর্বাগ্রে নিশ্চিতকরণ জরুরি। শিশুকে কখনোই কোনো পরিবার, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়ের বাসা, পরিচিতজন, গৃহকর্মী, গাড়ীচালক, ফাঁকা বাসায় গৃহশিক্ষক ইত্যাদির কাছে একা রাখা বা তাদের জিম্মায় দেওয়া মোটেই উচিত হবে না, অর্থাৎ কোমলমতি শিশুদের যতটা সম্ভব বাবা-মায়ের তত্ত্বাবধানে এবং তাঁদের দৃষ্টিসীমার মধ্যে রাখতেই হবে। কোনো শিশুকেই কারো সঙ্গেই একা যেতে না দেয়া বা ঘরে একা না রাখা। শিশুরা কারো সঙ্গে একাকি সময় দিচ্ছে কিনা তা পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। স্কুল বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাওয়ার প্রতি শিশুদের অনীহা বা অনাগ্রহ পরিলক্ষিত হলে তার কারণ অনুসন্ধান করতে হবে। পাশাপাশি শিশুরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোনো প্রকার নির্যাতনের শিকার বা তাদের কোনো প্রকার বুলিং করা হচ্ছে কি না তা জানার চেষ্টা করা ও সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। বেশিরভাগ অভিভাবকের যৌন বিষয়ক বাস্তব অভিজ্ঞতা ও সঠিক জ্ঞান না থাকার কারণে শিশু এবং নারীরা যৌন নিপীড়নের বা নিগ্রহের শিকার হন। অনেকেই সন্তানকে কিভাবে নিজেকে যৌন নিপীড়নের হাত থেকে রক্ষা করা যায় সে উপায় সম্পর্কিত দক্ষতাগুলো না শিখিয়েই বাইরের দুনিয়ায় পাঠিয়ে দেই যা হিতে বিপরীত হয়। তাই আপামর সকল অভিভাবকের উচিত এ সংশ্লেষে বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে যুক্তিসঙ্গতভাবে ব্যাপক চিন্তা করা। পরিবারের শিশুদের আচার আচরণের কোনো পরিবর্তন হচ্ছে কিনা লক্ষ রাখা।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত ছেলে মেয়েদের সাথে অভিভাবকদের সুন্দর, সাবলীল এবং বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলা দরকার। যাতে তারা স্কুল কলেজে তার সঙ্গে কে কী করছে তা সহজেই অবগত হওয়া যায়। পারিবারিক সম্পর্ক স্বাভাবিক না হওয়ার কারণে অধিকাংশ কিশোর, কিশোরী এবং মেয়েরা তাদের সঙ্গে ঘটা নিপীড়ন বা নিগ্রহের কথা পরিবারকে জানাতে ব্যর্থ হয়। ফলশ্রুতিতে এসকল কোমলমতি শিশু, কিশোর, কিশোরী নির্যাতনের শিকার হয়ে মানসিক অবসাদগ্রস্থতায় ভোগে, যা পরবর্তীতে স্থায়ী মানসিক রোগে পরিণত হয় এবং আত্মহত্যায় প্ররোচিত করে।
প্রত্যেকটি পরিবারের উচিৎ যৌন বিষয়ক নিরাপত্তার বিষয়ে শিশুদের সুশিক্ষিত করা, যেন তারা নিজেদের বিরুদ্ধে কোনো অন্যায় হলে তা পরিবারকেই প্রথমে জানাতে পারে। যথাযথ জ্ঞানের অভাবে অনেকে বুঝতেই পারে না তাদের যৌন নিপীড়ন করা হচ্ছে। বিধায় পরিবারের প্রথম দায়িত্ব বা পদক্ষেপই হতে হবে শিশুদের যৌন বিষয়ে সচেতন করা।
বিভিন্ন গবেষণা ও জরিপে শিশু যৌন নিপীড়ন সংক্রান্ত যে চিত্র ও পরিসংখ্যান পাওয়া যায় তা থেকে দেখা গেছে, আঠারতম জন্মদিনের আগেই প্রতি তিনটি মেয়ের একটি মেয়ে এবং প্রতি ছয়টি ছেলের একটি ছেলে যৌন নিপীড়নের শিকার হয়। আর এদের শীর্ষে থাকা শতকরা পঁচাশি ভাগ নিপীড়কই পূর্ব পরিচিত বা আগে থেকেই চেনা বা জানা। অবাক হতে হয় যখন দেখা যায় পরিচিতজন ভাল ও নিষ্পাপ মুখোশের আড়ালে কোমলমতি শিশুটিকে যৌন নির্যাতন বা নিগ্রহ বা ধর্ষণের জন্য ওৎ পেতে থাকে। মানুষরূপী পরিমলরা শুধু যে নামকরা স্কুলের ছাত্রীদের পিছনে লেগে থাকে তা না এরা শহর, বন্দর কিংবা গ্রামেও অবস্থান করে। এরা কখনও আবির্ভুত হয় আত্মীয়, বন্ধু, সহকর্মী, শিক্ষক, ওস্তাদ, সহপাঠী ইত্যাদি হিসেবে। এরা মুখোশধারী শয়তান বা বহুরূপী প্রাণী যারা বাবা-মা এর অগোচরে তাদের কোমলমতি শিশু বা সন্তান কে খুব বিশ্বাসী বন্ধুর আচরণে প্রভাবিত করে নিগৃহীত করার প্রচেষ্টায় লিপ্ত।
যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধের শিক্ষা প্রদান খুব সহজ হলেও একবার কোনো শিশু যৌন নিপীড়নের শিকার হয়ে গেলে বিষয়টি অধিক জটিল হয়ে পড়ে যা খুবই ধ্বংসাত্মক এবং জীবন বদলে দেওয়ার মত ঘটনায় পরিণত হতে পারে। তাই শিশুদেরকে খুবই অল্প বয়স থেকে যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধের পদ্ধতি সম্পর্কে শিক্ষা দিতে হবে। শিশুরা কথা বলা শুরু করা থেকেই তাদের স্ব স্ব দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো নিয়ে কৌতুহলী হয়ে থাকে এবং সেগুলোর নামও সঠিকভাবে বলতে শেখে। তাই পরিবার যখন হাত, পা, মাথা, কনুই ইত্যাদি সম্পর্কে শেখায় তখনই তাদের জননাঙ্গ সম্পর্কেও জানাতে হবে। যা শিশুদেরকে কেউ খারাপভাবে স্পর্শ করলে তারা সুস্পষ্টভাবে বলতে পারবে বা জানাতে পারবে তাদের কোন অঙ্গে স্পর্শ করা হয়েছিল। শিশুকে দৃঢ়তার সাথে শেখাতে হবে জননাঙ্গ, মলদ্বার, স্তন এবং স্তনবৃন্ত ইত্যাদি তাদের একান্তই ব্যক্তিগত অঙ্গ পাশাপাশি তার তাকে এটাও জানাতে হবে যে, তার মুখমণ্ডলও তার একান্তই ব্যক্তিগত অঙ্গ হিসেবে বিবেচিত হয়। শিশুকে শেখাতে হবে যে, তাদের এসকল ব্যক্তিগত অঙ্গগুলো স্পর্শ করার অধিকার কারো নাই এমন কি সেও অন্যদের এসব অঙ্গ স্পর্শ করতে পারবে না। কেউ যদি স্পর্শ করেও তাহলে সে যেন অনতিবিলম্বে তার বাবা-মা বা আস্থাভাজন ও বিশ্বস্ত প্রাপ্তবয়স্ক লোকদেরকে তা জানিয়ে দেয়। তাদেরকে এটাও শেখাতে হবে যে, বড়রা বিশ্বাস না করা পর্যন্ত যেন তাদেরকে অভিযোগের বিষয়টি বারংবার বলে যেতে থাকে। শিশুদের বয়স আড়াই থেকে তিন বছর অতিক্রম হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বাবা-মা এর উচিৎ তাদেরকে এমন পাঁচ-ছয়জন আস্থাভাজন প্রাপ্তবয়স্ক লোকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়া যাদেরকে তারা নির্দ্বিধায় সম্পূর্ণরূপে বিশ্বাস করতে পারে। এসকল লোক নির্বাচনে বাবা-মা কে অধিকতর সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। শিশুকে বলে দিতে হবে কেউ যদি তাদের একান্ত ব্যক্তিগত অঙ্গগুলো দেখতে চায় বা স্পর্শ করতে চায় বা তার নিজের ব্যক্তিগত অঙ্গগুলো দেখাতে চায় বা কোন ছবি বা ভিডিও দেখাতে চায় তা ঠিক নয় বরং এমনটা ঘটলে তারা যেন বিশ্বস্ত ও আস্থাভাজন প্রাপ্তবয়স্ক লোকদের জানিয়ে দেয়।
শিশুদেরকে মানবিক ও মানসিক অনুভূতির বিষয়েও শিক্ষা দেয়া জরুরি, তাদেরকে শেখাতে হবে সুখ, দুঃখ, রাগ, উত্তেজিত হওয়ার অর্থ কি এবং কিভাবে এসকল অনুভূতি প্রকাশ করতে হয়। ‘নিরাপদ-অনিরাপদ’ বা ‘ভাল-খারাপ’ অনুভূতি বোধ করার বিষয়ও শেখাতে হবে। এসবের সাথে আবেগগত ভিন্নতা বা পার্থক্য রয়েছে তাও শিক্ষণ-শিখনের অন্তর্ভূক্ত থাকতে হবে। বুঝিয়ে দিতে হবে যে, নিরাপদ বোধ করলে বা ভাল কিছু হলে সুখের অনুভূতি হয় এবং শরীরে একধরনের উষ্ণতা বোধ হতে পারে, কিন্তু অনিরাপদ বোধ করলে বা খারাপ কিছু ঘটলে মনের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হতে পারে, পেটের ভেতর অস্বস্তি লাগতে পারে, অসুস্থ বোধ হতে পারে, হৃৎপিন্ডের বিট বা কম্পন বৃদ্ধি পেতে পারে, হাত কাঁপা বা হাতে ঘামের সৃষ্টি পেতে পারে, কান্না পেতে পারে আর এসবই নিরাপত্তাহীনতা বা ভয়ের কারণে ঘটে থাকে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে দ্রুত পরিবর্তনশীল আধুনিক প্রযুক্তির সহজলভ্যতায় চ্যালেঞ্জিং বিশ্বে টিকে থাকার জন্য শিশুদেরকে প্রয়োজনীয় দক্ষতায় সুদক্ষ হওয়ার সকল কৌশলগুলো অনতিবিলম্বে শেখাতে হবে।
শিশুরা ছবিযুক্ত বই পছন্দ করে বিধায় দেহের নিরাপত্তার স্বার্থে দৈহিক নিয়ন্ত্রণ এবং লিঙ্গ সমতা বিষয়ে ছবিযুক্ত বইয়ের মাধ্যমে তাদেরকে প্রশিক্ষিত করে তোলা যেতে পারে। একদিকে যেমন শিশুদেরকে প্রশিক্ষণ দিতে হবে অন্যদিকে তাদের বাবা-মাকেও দৈহিক নিরাপত্তার মতো বিষয়গুলো সম্পর্কে সুস্পস্ট ধারণা থাকতে হবে। বাবা-মাকে অবশ্যই অবশ্যই শিশুদের মানসিক বিকাশের যাবতীয় কৌশল সম্পর্কে জ্ঞানার্জন করতে হবে। কোমলমতি শিশুটি যৌন নিগ্রহের শিকার হচ্ছে কিনা তা বোঝার মত অতন্দ্র পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা থাকতে হবে। শিশু যৌন নিপীড়িত হওয়ার কথা বললে বা ইঙ্গিত দিলে তা অগ্রাহ্য না করে বরং তা আমলে নেয়ার মানসিকতা থাকতে হবে কারণ বেশিরভাগ শিশুই এ বিষয়ে মিথ্যার আশ্রয় নেয় না।
আমরা সাধারণত: যখন দেখি একটা শিশু বা নারী যৌন নিগ্রহের শিকার হয়েছে বা লাঞ্চিত হয়েছে তখন কয়েকদিন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনা করে ভাইরাল করে ফেলি কয়েকদিন পর নিজেরাই ভুলে যাই অথচ নিগ্রহকারী এটা না ভুলে পরবর্তী শিকার এর সন্ধানে লিপ্ত থাকে। এটা বুঝতে চাই না যে, হাতেগোণা কয়েকটা খবরই প্রচার পায় বেশীরভাগই থেকে যায় অগোচরে বা অনেকেই প্রকাশ করতে লজ্জা পায়। কিন্তু থেমে থাকে না মানুষরূপী কিছু নিগ্রহকারী প্রণী। এর মূলে রয়েছে সমাজের মানুষের অন্যের বিপদে এগিয়ে আসার বিষয়ে অনীহা, সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হওয়ার ভীতি, দূর্বল মানসিকতা, পারিবারিক সুশিক্ষা ও যথাযথ মূল্যবোধের অভাব, আপাত প্রভাবশালীর যন্ত্রণা, ভিক্টিমের আইনী সহযোগিতার অভাব বা তা গ্রহণে অনীহা বা অজ্ঞতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের ঘাটতি, সতর্কতা ও সচেতনতার অভাব, অভিজ্ঞ কাউন্সিলর/পরামর্শদাতার অভাব, গোড়ামি, ঠুনকো লজ্জাবোধসহ হাজারো সমস্যা। সমাজের প্রতিটি স্তর থেকে যদি সম্মিলিতভাবে এর বিরুদ্ধে আওয়াজ উঠতো, এহেন ঘৃণ্য কাজ প্রতিহত করত এবং যথাযথভাবে বিদ্যমান আইনের বাস্তবায়ন প্রতিপালনসাপেক্ষে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা যায় তাহলে যৌন নিপীড়করা এত সহজে অপকর্ম করার সাহস পেত না বলে প্রতীয়মান হয়। তাই বাবা-মা’কেই সাবধান থাকতে হবে এবং নিজের সন্তানকে নিজেকেই রক্ষা করতে হবে এর কোন বিকল্প নাই।
বাবা-মা’কে পারিবারিকভাবেই নিম্নের বিষয়গুলি নিশ্চিত করতে হবে:
– শিশুরা যেহেতু প্রথম নির্যাতিত হয় কাছের মানুষ দ্বারা সেহেতু শুনতে ভালো না লাগলেও ভাই, চাচা, মামা, খালা, ফুফু, কিংবা কাজের লোকের নিকট বাচ্চা রাখা যাবে না বিশেষ করে বাচ্চা যখন একটু বড় হয়ে যায়। সন্তানকে কখনই কারো কোলে দেয়া বা কারও কোলে বসতে দেয়া বা তাকে জড়িয়ে ধরে আদর করতে দেয়া সম্পূর্ণরূপে বারিত করতে হবে। ব্যস্ততম নাগরিক বা গ্রামীণ জীবনে অনেক সময়েই অনেক দূরের বা কাছের আত্মীয় স্বজন বাসায় বেড়াতে আসেন তখন অনেকেই জায়গার অভাবে সন্তানকে তাদের সাথে বিছানা ভাগাভাগি করতে বলেন এটা করা যাবে না। কেননা আত্মীয়টি যদি অমানুষ হয়ে থাকে তবে সে এ সুযোগটাই কাজে লাগাবে;
– শিশুদের সামনে কাপড় পাল্টানো যাবে না এবং শিশুদেরকেও শেখাতে হবে কাপড় পাল্টানোর নিয়ম ঘরের দরজা বন্ধ করে অন্যের সামনে নয়। মার্জিত পোষাক পরিচ্ছদ পরিধানের শিক্ষা দিতে হবে শিশুকে, ড্রেসকোড সম্পর্কে ধারণা দিতে হবে। এমন কি শিশুদের সামনে বাবা-মা কখনই বেশী অন্তরঙ্গ হবেন না কারণ এতে শিশুটি অল্পতেই সংবেদনশীল (Sensitized) হয়ে যেতে পারে। অনেক সময় দেখা যায় একজনের শিশু সন্তানকে আদর করে অন্যের ছেলের বউ বা মেয়ের জামাই বলে সম্বোধন করে, এটাকে প্রশ্রয় দেয়া যাবে না;
– শিশু সন্তান কোথাও খেলতে গেলে নজরে রাখতে হবে যে, সে কি ধরনের খেলা খেলছে, খেলার সঙ্গী কে, বড়দের সাথে খেলছে কি না, চোখের আড়ালে গিয়ে খেলছে কি না, বাবা-মা যদি দুপুরে ঘুমিয়ে থাকেন তখন সে খেলতে যাচ্ছে কি না বা তাকে কেউ ঐসময় ডেকে নিয়ে যাচ্ছে কি না ইত্যাদি। বাচ্চা বাইরে খেলতে যেতে চাইতেই পারে এমনকি মানসিক বিকাশের জন্য বাইরে পাঠাতে হয় সেক্ষেত্রে বাচ্চাকে দেখভাল করতে পারেন এমন বিস্বস্ত কাউকে দায়িত্ব দিতে হবে; কোন আত্বীয় বা বন্ধুর বাসায় শিশু সন্তানকে জোর জবরদস্তি করে পাঠানো যাবে না যেখানে সে স্বস্তি বোধ করে না বা যেতে চায় না বা এমন কারও কাছে পাঠানো যাবে না যার কাছে সে আগে যেতে পছন্দ করত কিন্তু এখন যেতে চায় না। বরং এক্ষেত্রে অনুসন্ধান করে মূল কারণ বের করা জরুরি;
– হঠাৎ দেখা গেল উচ্ছ্বল ও প্রাণবন্ত শিশুটি কেমন যেন খুব চুপচাপ হয়ে গেছে বা নিজেকে সব কিছু থেকেই গুটিয়ে নিচ্ছে তখন বাবা-মা’কে নিজ থেকেই এর কারণ চিহ্নিতকরণে এগিয়ে আসতে হবে সর্বাগ্রে এবং কৌশলে কারণ উদঘাটনের পাশাপাশি সন্তানকে বোঝাতে হবে বাবা-মা’ই তার সবচেয়ে আপনজন এবং তারাই তার সমস্যার সমাধানে সহযোগিতা করতে পারবেন অন্য কেউ নয়;
– টেলিভিশন বা যেকোন রিয়েলিটি শো বা কার্টুন বা সিনেমা বাচ্চাদের দেখানোর পূর্বে বাবা-মা’কে দেখে নিতে হবে তাতে আপত্তিকর বা অসামাজিক কিছু আছে কিনা। যদি থাকে তবে সন্তানকে তার ভাল-মন্দ দিক বুঝিয়ে তা দেখা থেকে দূরে রাখতে হবে। অনেক আপত্তিকর চ্যানেল আছে যা চালু থাকলে সন্তান কৌতুহলী হয়ে দেখতে চাইতে পারে সেসব চ্যানেল অবশ্যই বন্ধ রাখতে হবে, এমনকি বাবা-মা’ও নিজে দেখবেন না পাশাপাশি সন্তানকেও দেখতে দিবেন না। মনে রাখা প্রয়োজন নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি মানুষের কৌতুহল বেশী থাকে। অধিক সাবধান হতে হবে ইন্টারনেট ভিত্তিক পর্ন সাইটগুলোর বিষয়ে, এসকল সাইট ব্লক করে রাখা যেতে পারে। বাংলাদেশ সরকার অবশ্য এ বিষয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ নিয়ে সফল হয়েছে কিন্তু প্রক্সি সার্ভার ব্যবহার করে অনেক দুষ্টু লোক তা তাদের নিজের স্বার্থেই ব্যবহার করছে। তাই সন্তান কি ধরনের সাইট ভিজিট করে সে বিষয়ে নজর রাখা প্রয়োজন। অনেক সময় বাচ্চারা বিভিন্ন প্রাণীর আচরণ সম্বলিত ডিসকভারী চ্যানেল ভক্ত হয় যা দোষের নয় কিন্তু সে চ্যানেলে যদি পশুর যৌন কর্মকান্ড দেখানো হয় তবে বাচ্চার সংবেদণশীল হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়ে যায় যা ভবিষ্যতে বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য দায়ী হতে পারে, কোন জোর জবরদস্তি না করে শিশুকে এর ভালো মন্দ দিক বোঝাতে হবে। মনে রাখা জরুরি বাবা-মা শিশুর যৌন শিক্ষা বিষয়ে আসল শিক্ষক। যৌন শিক্ষা দিতে বাবা-মা’কেই সাবধানতার সাথে এগিয়ে আসতে হবে কারন তারাই তাকে গুরুত্বপূর্ন এ বিষয়ে যথাযথভাবে শিক্ষা দিতে পারবেন। সন্তানকে নৈতিক শিক্ষা দিতে হবে এটা হয়ত তাৎক্ষণিক বা একদিনে তা সম্ভব নয় কিন্তু ধীরে ধীরে দেয়া সম্ভব। এক্ষেত্রে বাবা-মা ব্যর্থ হলে সমাজই শিশুকে তা শেখাবে যা ভুল পথেও হতে পারে;
– শিশুকে বোঝাতে হবে কখনই যেন কাউকে সুযোগ না দেয় যৌনাঙ্গে হাত দিতে, এমনটা ঘটলে অবশ্যই যেন বাবা-মা’কে জানায়। পাশাপাশি তাকে শেখাতে হবে নিজের অঙ্গ নিজেকেই পরিস্কার রাখতে হবে অন্য কারও সহযোগিতা নেয়া যাবে না এবং বাবা-মা এর উচিৎ হবে না সন্তানের আড়াই থেকে তিন বছর বয়স হওয়ার পরে পিতা-মাতাও সন্তানের অঙ্গে হাত দিবেন না। চলার পথে ভিড়ের মাঝে অস্বস্তিকর বা খারাপ স্পর্শকে চিনতে সাহায্য করতে হবে, এ ধরনের স্পর্শ থেকে নিজেকে কিভাবে রক্ষা করা যায় তা সন্তানকে বলতে হবে। নিজেই নিজেকে বাচাঁনোর বা রক্ষা করার কৈাশল শেখাতে হবে।
– শিশুকে স্মার্ট ফোনের পরিবর্তে ফিচার ফোন দেয়া যেতে পারে জরুরি যোগাযোগের জন্য, সেইসাথে তাকে কিভাবে স্পিড ডায়াল ব্যবহার করতে হয় তাও শিখিয়ে দিতে হবে এবং স্পিড ডায়ালে জরুরি সেবা বা সহযোগিতা পাওয়ার সুবিধার্থে বিভিন্ন হট লাইন নম্বর সেভ করে দিতে হবে।
শিশুর আচরণ থেকে কি বুঝা যায় যে, সে নির্যাতিত বা নিপীড়িত হয়েছে কি না? যৌন হয়রানি বা যৌন নিপীড়ন এর বিরুদ্ধে সচেতনতা কিভাবে বৃদ্ধি করা যায়? সচেতনতাই কি শেষ কথা? পারিবারিক শিক্ষাটাই বা কেমন হওয়া উচিত?
শিশুদের যৌন নিপীড়িত হওয়ার লক্ষণ বা তাদের আচরণ বুঝতে গেলে একটি বা দুটি লক্ষণ দেখেই অনুমান করা সম্ভব হয় না যে শিশুটি যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছে কি না। তবে একই লক্ষণগুলো যদি বারংবার দেখা যায় তাহলে সতর্ক হতে হবে এবং অধিক অনুসন্ধান চালাতে হবে। শিশুদের যৌন নিপীড়ন বা নির্যাতনের শিকার হওয়ার কিছু সরাসরি দৃশ্যমান লক্ষণ রয়েছে যা নিম্নে উপস্থাপন করা হলো:
– নিজের বা অণের যৌনাঙ্গর প্রতি নিয়মিত আগ্রহ প্রকাশ করা;
– বিভিন্ন অযুহাতে একান্ত ব্যক্তিগত অঙ্গগুলো স্পর্শ করতে চাওয়া বা স্পর্শ করা;
– অন্য শিশুদের সঙ্গে ‘যৌন খেলা’ করতে আগ্রহ প্রকাশ করা;
– বাঁধা দেয়া সত্ত্বেও নিয়মিত মাস্টারবেশন করার মত ইঙ্গিত করা বা অঙ্গভঙ্গি করা;
– যৌন উত্তেজনামূলক কথা বলা এবং অভিজ্ঞদের ন্যায় যৌনাচরণ করা;
– পুতুল বা খেলার সামগ্রীর মাধ্যমে যৌনতামূলক খেলা করা যার মধ্যে যোনি বা পায়ুপথ দিয়ে কোনো বস্তু ঠেলে ঢোকানোর মতো আরচণ দৃষ্টিগোচর হয়;
– অহেতুক অনবরত দরজায় উঁকি-ঝুকি দেয়া;
– ব্যক্তিগত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ প্রদর্শন;
– প্রাপ্তবয়স্কদের জননাঙ্গ বা অপরিচিত শিশুদের জননাঙ্গের বিপরীতে নিজের জননাঙ্গ স্পর্শ করানো;
– নোংরা বা অশ্লীল শব্দ চয়নে কথা বলা বা মৌখিকভাবে যৌনতাপূর্ণ কটু কথা বলা;
– যৌন কার্যকলাপের বিবরণ দেওয়া বা বয়সের তুলনায় অধিক যৌনতা সংশ্লেষে আচরণ প্রকাশ করা;
– যৌন কর্মের ছবি আঁকা বা গেম খেলা;
– শরীর থেকে তীব্র কটু গন্ধ বের হওয়া বা মুখের চারপাশে ঘা, যৌনাঙ্গে আঁচড়, কালশিটে বা রক্তপাত;
– স্তন, পশ্চাৎদেশ, তলপেট ও পায়ে বা উঁড়ুতে আঁচড় বা কালশিটে;
– ভারসাম্যহীন বা উদ্বেগপূর্ণ আচরণ করা;
– নিজেকে গুটিয়ে নেয়া ও কোনো কিছু গোপন রাখার চেষ্টা করা;
– বিছানায় ঘুমাতে যাওয়ার সময় পুরো দেহ ঢেকে রাখার মতো পোশাক পরা বা প্রতিকূল আবহাওয়ায়ও চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমানো;
– চাদর মুরি দিয়ে মোবাইল বা ট্যাব চালানো কিংবা পর্ণ ছুব বা মুভি দেখা;
– পশ্চাদমুখী আচরণ, যেমন বিছানা নোংরা করা বা ভিজিয়ে ফেলা;
– আচরণে হঠাৎ পরিবর্তন, যেমন হঠাৎ রেগে ওঠা বা অস্থির ও অসহিষ্ণু আচরণ করা;
– ক্ষুধার স্বাভাবিক অনুভূতিতে পরিবর্তন আসা;
– অযৌক্তিক অর্থ সংগ্রহ বা উপহার সামগ্রীর আগমন;
– আত্মধ্বংসী আচরণ করা, যেমন মাদকাসক্তি, আত্মহত্যা প্রবণতা, স্ব-অঙ্গহানি;
– কিশোর গর্ভধারণ;
– বাড়ি থেকে দূরে থাকার প্রবণতা বা স্কুলে যেতে অনীহা;
– অহেতুক নিজের শরীর নোংরা হয়ে গেছে বলা;
– বিশেষ কোনো আত্মীয় বা ব্যক্তির বাসায় বা সংস্পর্শে যেতে না চাওয়া বা ঘন ঘন যাওয়া যা স্বাভাবিকতা বিবর্জিত, ইত্যাদি বিষয়গুলি শিশুর যৌন নিপীড়ন বা নিগ্রহের শিকার হওয়ার ইঙ্গিত বহন করে।
যৌন হয়রানি বা যৌন নিপীড়ন থেকে শিশুদের রক্ষা করতে হলে সবচাইতে জরুরি যথাযথ যৌন শিক্ষার মাধ্যমে তাদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি। সব পরিবারকেই শিশুদের যৌন বিষয়ক নিরাপত্তার শিক্ষা দিতে হবে, যাতে তারা নিজেদের বিরুদ্ধে কোনো অন্যায় হলে তা পরিবারকে যেমন জানাতে পারে তেমন সে যেন বুঝতে পারে যে তাকে যৌন নিপীড়ন করা হচ্ছে। তাই বাবা-মা তথা পরিবারের প্রথম দায়িত্বই হতে হবে শিশুদের যৌন বিষয়ে সচেতন করা।
সমাজ থেকে যৌন নিপীড়নের ন্যায় অনাকাঙ্খিত ঘটনা নির্মূল করতে হলে জরুরি প্রয়োজন হল সচেতনতা। পরিবার, সমাজ এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যত বেশি সচেতনতা সৃষ্টি করা যাবে তত বেশি যৌন নিপীড়নের মতো ঘটনা সমাজ থেকে দূর করা যাবে। সঠিক ধর্মীয় অনুশাসনও যৌন নিপীড়ন থেকে সমাজকে রক্ষা করতে অধিক কার্যকর। সবাইকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে ঐক্যবদ্ধভাবে। আজ হয়ত অন্যের সন্তান নিপীড়নের শিকার হচ্ছে কাল যে আমার সন্তান নির্যাতিত হবে না এমন কোন নিশ্চয়তা পাওয়া যায় না।
শিশুদের যৌন নিপীড়ন বা নির্যাতন নিয়ে বেশ কিছু ভ্রান্তকর ধারণা সমাজে বিদ্যমান যেমন-
– অনেকেই মনে করেন, শিশুরা অপরিচিত ব্যক্তিদের দ্বারা নিপীড়িত হয়;
– শুধু মেয়েশিশুরাই যৌন নিপীড়নের শিকার হয়;
– কেউ কেউ ভাবেন দরিদ্র পরিবারের শিশুদের নিপীড়নের শিকার হওয়ার ঝুঁকি বেশি ইত্যাদি।
কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন কথা বলে বাংলাদেশসহ বিশ্বের নানা দেশেরেএ সংশ্লেষে ঘটনা পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, ছেলে-মেয়ে উভয়েই নির্বিশেষে যৌন নিপীড়নের শিকার হয়। শিশুর পরিচিত ও অপরিচিতজন এমনকি নিকট আত্মীয়রাও নিপীড়ক বা নিগ্রহকের ভূমিকায় অবতীর্ণ। তবে দূঃখের বিষয়, গবেষণায় দেখা যায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শিশু পরিচিত এবং নিকট আত্মীয় কারও দ্বারাই প্রথম নিপীড়নের ঘটনার শিকার হয়েছে। এমনও দেখা যায় শুধু পুরুষ নয় নারীরাও শিশুর ওপর যৌন নিপীড়ন করে থাকে। কখনও কখনও তুলনামূলকভাবে একটু বয়স্ক শিশুরা (ছেলে বা মেয়ে) কম বয়স্ক শিশুদের নিপীড়ন বা নির্যাতন করে থাকে। এর মূল কারণই হলো বাবা-মা বা পরিবার কর্তৃক যথাযথ যৌন শিক্ষা এবং পারিবারিক উন্নত মূল্যবোধের অভাব। গ্রাম-শহর যেকোন সামাজিক অবস্থান বা বয়স হোক না কেন শিশুরা নিপীড়িত হচ্ছে, সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে থাকে প্রতিবন্ধী শিশু, কর্মজীবী শিশু, পথ শিশু বা পথে বসবাসকারী শিশুসহ বেশকিছু শিশু যাদের অবস্থান ও অবস্থা খুবই নাজুক। মনে রাখতে হবে শিশুর প্রতি যৌন নিপীড়ন বা নির্যাতন বিভিন্নভাবে ঘটতে পারে সেটা অবাঞ্ছিত স্পর্শ থেকে শুরু করে ধর্ষণ পর্যন্ত হতে পারে।
সাবধানতা এবং সতর্কতার সাথে সন্তানকে বয়ঃসন্ধিকালীন সঠিক যৌন শিক্ষা দেয়ার পাশাপাশি তাকে এ সংশ্লেষে বিভিন্ন শারীরিক ও স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি বা অপকারিতা সম্পর্কে এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বিষয়ে সচেতন করতে হবে। খারাপ কাজ, বাজে অভ্যাস, মন্দ ব্যক্তি, মন্দ স্পর্শ, কুরুচিপূর্ন বিষয় এবং নিন্দনীয় আচরণের একটি তালিকা তৈরি করে সন্তানকে সতর্কতার সাথে শিক্ষা দিতে হবে। এই ক্ষেত্রে একটি বিষয় জরুরি সন্তানকে যা জানানো হবে তার সবগুলোর যূক্তিসঙ্গত কারণসহ তাকে ব্যাখা করতে হবে কোন আজগুবি বা অলীক বিষয়ের অবতারণা করা থেকে বিরত থাকতে হবে। শৈশব থেকেই সন্তানকে প্রতিকুল পরিবেশে প্রতিবাদ করার জন্য অনুপ্রেরণা প্রদানের সাথে সাথে কিভাবে বাজে ও অপ্রতিকর পরিস্থিতিতে আত্মরক্ষা করতে হয় সেবিষয়ে প্রয়োজনীয় ধারনা ও শিক্ষা প্রদানের পাশাপাশি সচেতন করতে হবে। একটা বিষয় উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশের সংস্কৃতি অনুযায়ী এ ধরনের কাজ বাবার চেয়ে মা এর পদক্ষেপ গ্রহণ সহজ কারণ এদেশের বাবারা সেভাবে তৈরি হয় নাই তবে শৈশব থেকেই যদি সন্তানকে সঠিক ও যথাযথ যৌন শিক্ষা প্রদান করা হয় তবে অদূর ভবিষ্যতে বাবারাও সহজেই একই কাজ করতে পারবে। বাবাদের অধিক মনযোগী হতে হবে সন্তানের সাথে ঘনিষ্ঠ হতে বা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করতে।
অনেক সময় বেশিরভাগ শিশু ভয় বা লজ্জায় নিপীড়নের বা নির্যাতনের ঘটনা প্রকাশ করতে পারে না বা প্রকাশে ইচ্ছুক থাকে না। এক্ষেত্রে মা-বাবা এবং পরিবারের সদস্যগণকে এটা নিবিড় পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে পূর্বে বর্ণিত পন্থায় লক্ষণ বিচার বিশ্লেষণপূর্বক বুঝে নিতে হবে। তারপরও কিছু লক্ষণ যেমন যৌন আচরণে অসংগতি বা অযাচিত পরিবর্তন, মাথা বা পেটে ব্যাথার অযুহাতে স্কুলে না যাওয়া, স্কুলে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন কিংবা পরীক্ষার ফলাফল প্রতিনিয়ত খারাপ হওয়া, স্বাভাবিক আচরণ বদলে যাওয়া, খেলাধুলায় উৎসাহ হারিয়ে ফেলা উপরন্তু পিয়ার গ্রুপ বা সমবয়সী এবং বয়স্কদের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষায় বিভিন্ন সমস্যায় পতিত হওয়া। শিশুর আচরণে এ ধরনের কোনো পরিবর্তন দেখা দিলে অভিভাবকের উচিত হবে এ সম্পর্কে অধিকতর খোঁজখবর বা অনুসন্ধান করা যে কোন নিপীড়ন বা নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে কি না বা তা বোঝার চেষ্টা করা।
শিশুর কথা বাবা-মা’কে মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে, তাদের ওপর বিশ্বাস রাখার পাশাপাশি নিজেদের অনুভূতির ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা প্রয়োজন। শিশুর কথাকে অগ্রাহ্য করা বা এড়িয়ে যাওয়া যাবে না এমন কি তাদের কথায় হাসি ঠাট্টা করা যাবে না। যৌন নিপূড়ন বা নির্যাতনের মত অনাকাঙ্খিত কোন ঘটনা ঘটেই গেলে শিশুটিকে মানসিক সাপোর্ট দেয়ার পাশাপাশি তাকে বোঝাতে হবে ঘটনার জন্য সে নিজে কোনোভাবেই দায়ী নয় বরং নিপীড়নকারী ব্যক্তিটিই দোষী এবং তার আচরণ কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য নয় বা ক্ষমার অযোগ্য। শিশুকে আশ্বস্ত করতে হবে যে তার সুরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। প্রয়োজন অনুযায়ী শিশুটিকে চিকিৎসা, কাউন্সেলিং ও আইনি সহায়তা দিতে হবে।
ঘটনা চেপে না রেখে পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের নিপীড়নকারী সম্পর্কে জানিয়ে রাখতে হবে, যাতে তাঁরাও তাদের সন্তানদের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে পারেন। শিশুদের বুঝতে দেওয়া যাবে না যে বড়রা এ নিয়ে খুব দুশ্চিন্তা করছেন। এছাড়াও বাড়াবাড়ি বা অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া দেখানো, শিশুটিকে অনেক প্রশ্ন করা বা তাকে শাস্তি দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে বরং এমন কিছু করা যাতে শিশুটি স্বস্তিবোধ করে, ভীত বা বিরক্ত না হয়। অবশ্যই ঘটনাটি তুচ্ছ তাচ্ছিল্যভাবে দেখা যাবে না বা নিপীড়নকারীর পক্ষ নেওয়া যাবে না। এ ধরনের আচরণ শিশুটির মধ্যে নিজের সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা তৈরি করতে পারে।
শিশুর ওপর যৌন নিপীড়ন বা নির্যাতন প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রে মা-বাবার সঙ্গে শিশুর সম্পর্কের উষ্ণতা খুবই গুরুত্ব বহন করে। শিশুরা নিজেদের কথা বা মতামত তখনই প্রকাশ করতে পারবে যখন মা-বাবার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ভয় কিংবা সংকোচহীন হয়। তাই সন্তানদের সঙ্গে মা-বাবার এমন সম্পর্ক গড়ে তোলা প্রয়োজন যাতে তারা মা-বাবার কাছে নির্ভয়ে সবকিছু উপস্থাপন করতে পারে।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মা-বাবা তথাকথিত আপাত পারিবারিক সম্মানের ভয়ে নির্যাতনকারীর যে কিনা নিজের আত্মীয় স্বজনের বা পরিবারেরই একজন তার বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেন না। এহেন ক্ষেত্রে সন্তানের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া বা প্রভাবের সৃষ্টি হয় এবং মানসিক বিকাশ বাঁধাগ্রস্থ হয় ফলশ্রুতিতে মা-বাবার সঙ্গে তাদের সম্পর্কের অবনতি ঘটে ও ভবিষ্যৎ জীবন গঠণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মা-বাবা’র মনে রাখা প্রয়োজন সন্তানের মঙ্গলের চেয়ে আত্মীয়ের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা কোনভাবেই গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে না।
শিশুকে যৌন নির্যাতনের বিষয়ে জ্ঞান দিতে গিয়ে বা সতর্ক করতে গিয়ে তাকে ভীতু বা আতঙ্কিত করা হচ্ছে কি? শিশুকে কিভাবে স্বাবলম্বী ও আত্মবিশ্বাসী করা যায়? এ বিষয়ে বাবা-মা এর শিশুর প্রতি আচরণ কেমন হওয়া প্রয়োজন?
শিশুদের মধ্যে কি ভয় বৃদ্ধি করে দেয়া হচ্ছে?
শিশুকে যৌন নির্যাতনের বিষয়ে জ্ঞান প্রদানের কাজটি করার পূর্বে বাবা-মা’কে নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে প্রথমেই। কিভাবে জ্ঞান দেয়া যায় সে বিষয়টি পূঙ্খানুপূঙ্খভাবে ভাবতে হবে এবং কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। যৌন জ্ঞান যাতে বিরক্তিকর কিছু না হয় সেজন্য বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন জরুরি, যেমন খেলার ছলে, ছবি এঁকে অথবা গল্প করে ধীরে ধীরে ধারণাটা শিশুর মনোজগতে প্রবেশ করাতে হবে। শিশু যদি বড় হয় তবে সরাসরি মুখে বলা যেতে পারে। মনে রাখতে হবে এ জ্ঞান বা ধারণা একবার প্রদান করেই কাজ শেষ ভাবা চলবে না কারণ শিশুরা অল্প সময়েই এটা ভুলে যাবে কেননা তারা এখনও সন্দেহ করা বা নিরাপত্তাহীনতা বিষয়গুলিই ঠিকভাবে বুঝে উঠতে পারছে না, তাই তাদের যৌন বিষয়ক জ্ঞান বা ধারণা শোভনভাবেই মাঝেমাঝেই মনে করিয়ে দিতে হবে। জ্ঞান প্রদান কালে বা অন্য যেকোন সময়েই শিশুর কথা শোনার পাশাপাশি তাকে বিশ্বাস করতে হবে, বেশিরভাগ অভিভাবকদের মধ্যেই শিশুর কথা না শোনা বা অগ্রাহ্য করার একটা সহজাত প্রবণতা আছে এটা পরিহার করতে হবে।
শিশুকে যৌন বিষয়ে জ্ঞান প্রদানের ক্ষেত্রে একটা বিষয় খুবই সতর্কতার সাথে মনে রাখতে হবে যে, এ বিষয়ে তাকে জ্ঞান দিতে গিয়ে কোনভাবেই ভীত বা আতংকিত করা যাবে না। বিষয়টিতে শুধু সতর্ক থাকতে হবে তাকে বোঝাতে হবে সব মানুষই খারাপ না। কে ভালো বা কে খারাপ বা তাদের আচরণই বা কেমন হবে এ বিষয়গুলো সুস্পষ্টভাবে বোঝাতে হবে। শিশুর মধ্যে আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি করতে হবে। শিশুর আচরণিক পরিবর্তন পর্যবেক্ষণ করতে হবে। বাচ্চার আচরণ থেকেও অনেক সময় অনেক কিছু অনুধাবন করা যায়। সে যদি কাউকে দেখে ভয় পায়, কারো কোলে যেতে না চায় তবে তাকে জোর করা উচিৎ হবে না। যে বাচ্চা বিছানা ভেজানো বন্ধ করে দিয়েছে, সে যদি হঠাৎ আবার তার পুনরাবৃত্তি করে বা সে যদি ভয় পেয়ে চমকে ওঠে বা রাতে দু:স্বপ্ন দেখে তবে তার কারণ অনুসন্ধানপূর্বক তার সমাধান করতে হবে এবং শিশুর মনোবল বৃদ্ধিতে সহায়ক কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে।
ভয় এমন একটা মানসিক অবস্থা যা জীবন হুমকি উদ্দীপনা (বাস্তব বা কল্পনা) সৃষ্টিকারী এবং এটির বহিঃপ্রকাশ ঘটে মানসিক এবং শারীরবৃত্তীয় প্রতিক্রিয়ার সংমিশ্রণে। যখন কেউ ভয় পায় তার দেহে অভাবনীয় শারীরবৃত্তীয় ও মানসিক পরিবর্তন ঘটে। ভয়ের ভিত্তি হল আত্ম সংরক্ষণের প্রবৃত্তি। শিশুদের ভয় দুটি ক্ষেত্রে হতে পারে যেমন-
– বিপদের প্রকৃত পরিস্থিতিতে; বা
– অন্য লোকের সাথে যোগাযোগের প্রক্রিয়ায়।
জীবনের চলতি পথে কোন কারণে শিশুটি ট্রমাজনিত পরিস্থিতির শিকার হয়েও তার স্বতন্ত্র অভিজ্ঞতা অর্জন করে থাকে। এছাড়াও শিশুর উপস্থিতিতে প্রাপ্তবয়স্কদের অস্থির কথোপকথন দ্বারা ভয় এর ভিত্তি তৈরি হতে পারে। বাবা-মা এর দায়িত্বই হল সন্তানের উদ্বেগ এবং ভয় লক্ষ্য করা এবং তাদের সমস্ত ভীতি দূর করার পদক্ষেপ গ্রহণ করা। যদি কোন কারণে শিশুর মধ্যে ভয়ের সৃষ্টি হয় তবে নিম্নবর্ণিত পন্থাসমূহ অবলম্বন করা যেতে পারে:
– শিশুদের মধ্যে ভয় কাজ করলে তাকে বোঝাতে হবে যে বেশিরভাগ লোকই ভালো অল্পকিছু লোক আছে যারা খারাপ;
– বাস্তবতা হচ্ছে যত সতর্ক থাকা হোক না কেন, শিশুকে ভয় থেকে দূরে রাখাটা দুঃসাধ্য, বিভিন্ন সময়ে সে ভয়ের সম্মুখীন হবেই। তাই ভয়কে কিভাবে মোকাবেলা এবং প্রশমন করা যায় সে বিষয়ে জ্ঞান দিতে হবে;
– খুব ছোট শিশুর (যে শিশুকে বোঝানো মুস্কিল) বেলায় করণীয় হচ্ছে যখনই সে ভয় পাবে, তাকে কোলে তুলে নিতে হবে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত তার সঙ্গে থাকতে হবে বাবা-মা’কে যেন তার মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা তৈরি না হয়;
– শিশু ভয় পেলে বাবা-মা’কে অবশ্যই স্বাভাবিক থাকতে হবে। তাদের চেহারায় স্বাভাবিক ছাপ থাকলে শিশুর কিছুটা হলেও ভয় দূর হবে;
– বাবা-মা নিজে ভয় পেলেও শিশুর সামনে সাহসের অভিনয় করতে হবে। তাদের মধ্যে ভয় দৃশ্যমান হলে শিশুর মধ্যেও তা সঞ্চারিত হবে;
– নিরাপত্তা নিয়ে অতি সতর্কতাও শিশুমনে ভয়ের জন্ম দেয় তাই যৌন জ্ঞান প্রদানের ক্ষেত্রে সতর্ক করতে গিয়ে অতিরিক্ত ভয় দেখানো যাবে না। ধীরে ধীরে বয়সের অনুপাতে এবং মানসিক অবস্থার উপর ভিত্তি করে এগোতে হবে;
– ‘চিন্তা করো না-এমনটা আর হবে না’ বা ‘ভয় পেয়ো না, ভয়ের কিছু হয় নাই, সব ঠিক হয়ে যাবে’ এ কথাগুলো বলা যাবে না। এমন বললে শিশু মনে করবে তার মনোজগতে ঘটে যাওয়া ভাবনাগুলোকে উপেক্ষা করা হচ্ছে বা এ ধরনের আবেগ প্রদর্শণ ঠিক না। ফলশ্রুতিতে ভবির্ষতে সে কোন কথাই আর বলবে না বা চেপে যাবে;
– শিশুর ভয় নিয়ে হাসাহাসি বা বিদ্রুপ করা যাবে না, এসব শিশুর ভয় বৃদ্ধির পাশাপাশি তার নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস কমে যাবে;
– যৌন জ্ঞান দিতে গিয়ে জিন, ভূত, প্রেত, ডাকাত, বাঘ ইত্যাদির কাল্পনিক চরিত্রের সমন্বয়ে গল্প শুনিয়ে শিশুকে সচেতন করার চেষ্টাও করা যাবে না। এমনকি আনন্দ দেওয়ার জন্যও এমনটা করা থেকে বিরত থাকতে হবে। ভয় দেখানো, ভয়ের গল্প বলা এবং ভয়ের দৃশ্য দেখানোর বিষয়গুলো কোমলমতি শিশুমনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে যা ভবিষ্যৎ মানসিক সঠিক বিকাশের অন্তরায়। শিশুকে হরর মুভি, দুর্ঘটনার দৃশ্য, ভয়ংকর চিত্র দেখানো থেকেও বিরত থাকতে হবে;
– ভয়কে এড়িয়ে বা অস্বীকার না করে শিশুকে তা থেকে উত্তরণের পন্থা বা কৌশল শেখাতে হবে এবং সাবধান থাকার বিষয়ে পরামর্শ দিতে হবে;
– শিশুরা ভয় পায় এমন আবহ বা পরিবেশ তৈরি থেকে বিরত থাকতে হবে;
– দ্রুত সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যাবে না, আগে মন দিয়ে তার কথা শুনতে হবে তারপর ভয় দূর করার পদক্ষপে গ্রহণ করতে হবে;
– শিশুর আত্মবিশ্বাস ও মনোবল বৃদ্ধির পাশাপাশি স্বাবলম্বী করার লক্ষ্যে ধর্মীয় অনুশাসন শেখোনো যেতে পারে, ইতিবাচক গল্প বলা যেতে পারে সেই সাথে নিয়মিত চর্চা করানোর জন্য ঘুমানোর পূর্বে শিশুর কানের কাছে নিয়ম করে বলা যেতে পারে ‘আমি সাহসী, আমি পারি’ এই ধরনের ইতিবাচক কথা বারংবার বললে তা শিশুর অবচেতন মনে তা গেঁথে যাবে এবং একটা সময় শিশুর আত্মবিশ্বাস ও মনোবল বেড়ে যাবে।
বর্তমান চতুর্থ শিল্পবিপ্লব সংশ্লেষে উদ্ভাবিত তথ্য-প্রযুক্তির মিথস্ক্রিয়ায় সৃষ্ট ভার্চুয়াল জগৎ এর সাথে শিশুর জীবনকে কিভাবে সমন্বিত করা যায়?
বর্তমান চতুর্থ শিল্পবিপ্লব হল আধুনিক সুযোগ সুবিধা সম্বলিত তথ্য প্রযুক্তির যুগ যেখানে রয়েছে তথ্যের অফূরন্ত ভান্ডার। এ ভান্ডারকে যেমন ইতিবাচক কাজে ব্যাবহার করা যায় তেমন নেতিবাচক কাজেও ব্যবহার করা যায়। সাধারণত মানসিক বিকাশ পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত বা আঠার বছরের নীচের বয়সীদের পক্ষ এ ইতিবাচক ও নেতিবাচক বিষয়গুলির মধ্যে পার্থক্য করা দুষ্কর। কিশোর-কিশোরীদের তাই কখনোই ভার্চূয়াল মাধ্যম ব্যবহার করতে দেওয়া উচিত হবে না। কমপক্ষে ১৮ বছর বয়স না হওয়া পর্যন্ত ভার্চুয়াল জগৎ থেকে কিশোর কিশোরীদের দূরে রাখা সম্ভব হলে বেশীরভাগকেই যৌন নিপীড়ন থেকে বহুলাংশে দূরে রাখা যাবে। যেসকল ছেলেরা যৌন নিপীড়ন বা নির্যাতন করে থাকে তারা অবাধযোগ্য ইন্টারনেট থেকেই যৌন আসক্তি বা যৌন বিকৃতি অর্জন করে থাকে। পরবর্তীতে এরাই হিতাহিত জ্ঞানশূণ্য হয়ে যৌন নিপীড়নের মত কার্যক্রমের সাথে জড়িত হয়। প্রায়শঃ দেখা যায় মেয়েদের বা কিশোরীদের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ভার্চুয়াল জগতে ব্ল্যাকমেইল করেও যৌন নিপীড়ন করে বা যৌন নির্যাতিত হতে বাধ্য করে।
ইন্টারনেট ব্যবহার বৃদ্ধির সাথে পাল্লা দিয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে মনো-সামাজিক ও যৌন হয়রানি। সমাজের এমন কোন পর্যায় নেই যারা কোন না কোনভাবে এর শিকার হচ্ছেন না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মাধ্যমে শুধু নারী না পুরুষরাও এর অন্তর্ভূক্ত তারা একদিকে হারাচ্ছেন সামাজিক প্রতিপত্তি অন্যদিকে আত্মসম্মান। অনেক ক্ষেত্রে তারা শিকার হচ্ছেন দীর্ঘ মানসিক সমস্যার। পুরুষের বিকৃত মানসিকতার কারণে অনেক নারীই আত্মহননের মত ঘটনা ঘটাতেও পিছপা হচ্ছেন না। হয়রানির শিকার হয়ে কোন রূপ প্রতিকার না পাওয়ায় এরই মধ্যে অনেকেই ত্যাগ করছেন ভার্চুয়াল বিশ্ব। আইন প্রয়োগের বিধান থাকলেও সামাজিক ও পারিবারিক সচেতনতার অভাবে সে সুযোগ গ্রহণ করা হচ্ছে না। বাংলাদেশের অধিকাংশই ইন্টারনেট এর সঠিক ব্যবহার সম্পর্কে যথাযথ ওয়াকিবহাল নন। রাষ্ট্রীয়ভাবেও সকল ব্যবহারকারীদের ওপর নজরদারি রাখাও সম্ভব নয়। এছাড়া পুলিশ সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণার কারণেও অপরাধ বৃদ্ধি পাচ্ছে, অভিযোগ দিয়ে লাভ নেই এমন নেতিবাচক মানসিকতায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হয়রানি হলেও অভিযোগ প্রদান করার হার খুবই স্বল্প। অথচ তথ্য প্রযুক্তি আইনের মাধ্যমে দুষ্কৃতিকারীকে কঠোর শাস্তির সম্মুখীন করার সুযোগ রয়েছে। শিশুর যৌন হয়রানি প্রতিরোধে পারিবারিক ও সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রয়োজন ইন্টারনেটের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা। মনস্তাত্ত্বিক কারণে হীনম্মন্যতায় ভুক্তভোগী জনগোষ্ঠীই বেশী হয়রানিতে জড়িয়ে পড়ে। মানবিক মূল্যবোধ, পারিবারিক সুশিক্ষা এবং সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করা গেলে যৌন হয়রানি বহুলাংশেই হ্রাস করা সম্ভব বলে মনে করেন অন লাইন বিষেজ্ঞগণ।
অনেক সময় মা-বোনরা তাদের কিশোর মেয়ে বা বোনকে নিয়ে শপিং যান কিন্তু তারা কেনাকাটা বা ডিজাইন পছন্দের বিষয়ে এতটাই মশগুল থাকেন যে তাদের মাথায় ট্রায়াল রুমে হিডেন বা গোপন ক্যামেরা থাকতে পারে এ বিষয়টিই বিবেচনায় আসে না। এধরনের অনাকাংখিত পরিস্থিতি থেকে নিজেকে ও কোমলমতি কিশোরীকে সমাজের কিছু মানুষরূপী বিকৃত মানসিকতার প্রাণীর হাত থেকে নিজেদের সম্ভ্রম কে রক্ষা করতে অধিকতর সতর্ক হওয়া এবং পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা বৃদ্ধি করা খুবই প্রয়োজন। আধুনিক প্রযুক্তিগত সুবিধা নিয়ে কিছু নোংরা মানসিকতার লোক মেয়ে শিশু, কিশোরী, যুবতী বা নারীকে অসম্মান, যৌন হয়রানি, যৌন নির্যাতন ইত্যাদির নানা ধরনের পদ্ধতি অবলম্বন করছে। নিত্যনতুনভাবে তারা লাঞ্ছিত হচ্ছেন, তাদের জন্য আরেক আতঙ্ক হল বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে লুকানো বা গোপন ক্যামেরা। শপিংমল, ফ্যাশন হাউস, বিউটি পার্লার, ওয়াশরুম বা টয়লেট, আবাসিক হোটেল, সুইমিং পুল, চেঞ্জ রুম, পাবলিক টয়লেট, ড্রেসিংরুমসহ বিভিন্ন স্থানের ট্রায়াল রুমে স্থাপন করা হয় গোপন ক্যামেরা। সচেতনতার অভাবে মেয়েরা না বুঝেই এর শিকার হন এবং পরবর্তীতে ভয়ঙ্কর বিপদে পতিত হন। অনেকেই আছেন শপিং করতে গিয়ে পোশাক ট্রায়াল দেন কেননা এতে করে সঠিক মাপের পোশাক কেনা যায়। দেখা যায় বাড়িতে আসার পর যে পোশাকটি কিনেছেন তার মাপ ঠিক হয়নি। এজন্য দোকান থেকেই ট্রায়াল দিয়ে আসা খুবই ভালো উপায় আর এ সুযোগটাই নিচ্ছে সমাজের বিকৃত মস্তিষ্কের ও মানসিকতার কিছু মানুষরূপী প্রাণী। একটু সচেতন হলেই এ গোপন ক্যামেরা খুঁজে বের করা জটিল কোন বিষয় না। গোপন ক্যামেরা যত ছোটই হোক না কেন তা লুকানো সহজ নয়। যেখানেই যান কেন প্রথমেই পরীক্ষা করে দেখতে হবে কোথাও কোনো ক্যামেরা লুকানো আছে কি না।
গোপন ক্যামেরা চিহ্নিতকরণের প্রাথমিক ও সহজ কিছু টিপস নিম্নে উপস্থাপন করা হলো:
– প্রথমেই ভালোভাবে লক্ষ্য করতে হবে দৃশ্যমান কোন ক্যামেরা সেট করা আছে কিনা;
– ট্রায়াল রুমে (যেখানে কাপড় পরিবর্তন করে নতুন কাপড়েরর ফিটিংস মেলানো হয়) প্রবেশ করে সিম এক্টিভ মোবাইল ফোন দিয়ে কাউকে কল করার চেষ্টা করতে হবে। যদি কল করা সম্ভব হয় বা মোবাইলে ফুল নেটওয়ার্ক দেখায় তবে বোঝা যাবে গোপন ক্যামেরা নাই। আর যদি কল করতে ব্যর্থ হন বা নেটওয়ার্ক না থাকে বা হঠাৎ করে ডাউন হয়ে যায় তাহলে নিশ্চিত থাকুন যে ট্রায়াল রুমে গোপন ক্যামেরার উপস্থিতি আছে। কেননা বেশীরভাগ গোপন ক্যামেরার সাথে অপটিক্যাল ফাইবার ক্যাবল থাকে যা সিগন্যাল বা সংকেত ট্রান্সফার করাকালীন এর ইন্টারফেয়ারেন্স হতে থাকে ফলশ্রুতিতে ট্রায়াল রুমে মোবাইল নেটওয়ার্ক সঠিকভাবে কাজ করতে পারে না;
– শপিংমলে অনেক সময় ট্রায়াল রুমে আয়না থাকে যা আসল নাও হতে পারে অর্থাৎ টিনটেড গ্লাস হতে পারে (যেমনটা দামী গাড়ীর জানালায় থাকে, বাইরের থেকে মনে হয় আয়না কিন্তু ভিতর থেকে যাত্রী বাইরের সবকিছু স্পষ্ট দেখতে পায়) যা গোপন ক্যামেরার মতই ভয়ংকর। প্রযুক্তির অপব্যবহারের মাধ্যমে প্রকৃত আয়নার মাঝখানে যুক্ত করা হয় কৃত্রিম বা নকল আয়না যা দ্বিমুখী আয়না হিসেবেও পরিচিত। এ আয়নায় নিজের চেহারা বা অঙ্গভঙ্গি দেখা যাবে সহজেই কিন্তু বোঝার উপায় নাই না যে বিপরীত পাশে বা অন্যপাশে কেউ একজন সবকিছুই দেখছেন বা ভিডিও ধারণ করছেন। এক্ষেত্রে আপনার আঙ্গুল আয়নার উপর রাখুন যদি স্থাপিত আঙ্গুলের মাথা প্রতিবিম্ব আঙ্গুলের মাথার সাথে সমানভাবে না লাগে অর্থাৎ দুয়ের মাঝে যদি ফাঁকা থাকে তাহলে আয়না ঠিক আছে আর যদি আঙ্গুলের মাথা প্রতিবিম্বের মাথার সাথে সমানভাবে লেগে যায় তার অর্থ হলো আয়নাটি নকল এটা আসল আয়না না বরং দ্বিমুখী আয়না। কারন আসল আয়নার সিলভার প্রলেপ থাকে আয়নার পিছনে, যার জন্য আপনার আঙ্গুল ও প্রতিবিম্বের মধ্যে ফাঁকা থাকবে আয়নার পুরুত্বের জন্য। অন্যদিকে নকল আয়নার (দ্বিমুখী) সিলভার প্রলেপ থাকে আয়নার সামনে যার ফলে আঙ্গুল ও প্রতিবিম্বের মধ্যে কোন ফাঁকা থাকবেনা বরং উভয় একে অপরের সাথে লেগে থাকবে;
– ট্রায়াল রুমে ফ্যান বা এসি বা লাইট থাকলে সেগুলোও ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে দেখতে হবে তার সাথে কোন গোপন ক্যামেরা সেট করা আছে কিনা;
– অনেক সময় বর্তমান উন্নত প্রযুক্তির যূগে মাল্টি প্লাগ বা দেয়ালে স্থাপিত সকেট ইত্যাদি যেখানে স্ক্রু দিয়ে আটকানো থাকার কথা সেখানে স্ক্রুর পরিবর্তে গোপন ক্যামেরা সেট করা হয়ে থাকে;
– যে কক্ষে প্রবেশ করছেন লক্ষ্য করুন আসবাব কিংবা দরজার হাতল, অস্বাভাবিকভাবে লাগানো ছবির ফ্রেম, ল্যাম্পশেড, দেয়াল ঘড়ি ইত্যাদির মধ্যে গোপন ক্যামেরা আছে কি না;
– টয়লেটের কমোডের পাশে বা বেসিনের সাথে বা শাওয়ারের সাথে গোপন ক্যামেরা আছে কি না;
– ক্যামেরা সচল থাকা বা সচল হওয়ার জন্য তিনটি জিনিস জরুরি যেমন দৃশ্যমানতা, বিদ্যুতের উৎস ও যোগাযোগের সংযোগ বা নেটওয়ার্ক। বিধায় রুমের সুইচ বোর্ডের কাছাকাছি স্থান, বাল্ব লাগানোর ফাঁকা স্থান, টেলিভিশন বা ডিভিডি যন্ত্র রাখার প্রচলিত স্থান ইত্যাদি যথাযথভাবে পরীক্ষা করা;
– গোপন ক্যামেরার অবস্থান চিহ্নিকরণের জন্য রুম অন্ধকার করে অথবা অন্ধকার রুমে মোবাইলের ফ্লাশ লাইটের মাধ্যমে উজ্জ্বল আলো ফেলা এতে করে ক্যামেরা যত ক্ষুদ্রই হোক তাতে স্থাপিত লেন্সে নীল আলোর বিচ্ছুরণ;
– বর্তমানে গোপন ক্যামেরা খোঁজার অনেক অ্যাপস আছে যা ক্যামেরার নেটওয়ার্ককে আবিষ্কার করে ক্যামেরার অবস্থান চিহ্নিত করে;
– সতর্কতার সাথে (আগে থেকেই রুমে কেউ আছে কি না দেখে নিয়ে) ট্রায়াল রুমে প্রবেশ করে সব লাইট বন্ধ করে চারদিকে তাকিয়ে দেখতে হবে রুমের মধ্যে কোথাও লাল বা সবুজ আলোর বিন্দু দেখা যাচ্ছে কি না কারণ ঐধরনের সংকেত লুকিয়ে রাখা ক্যামেরার লেন্স থেকেই সৃষ্টি হয়;
– মনে রাখতে হবে গোপন ক্যামেরা সব সময়ই যে আকারে বড় হবে এমন না কখনও কখনও শার্টের বোতামের সমানও হতে পারে তা তাই এক্ষেত্রে এটা খুঁজে পেতে ফোনে ‘হাইড ক্যামেরা ডিটেক্টর’ অ্যাপসটি ডাউনলোড করে নিতে হবে। প্রাইভেট বা পাবলিক প্লেসে গিয়েই অ্যাপসটি চালু করে নিতে হবে। এ অ্যাপসগুলি একাধারে গোপন ক্যামেরা ও গোপন মাইক্রোফোন এর অবস্থানও অ্যালার্মের মাধ্যমে জানিয়ে দেয়;
– অতিরিক্ত সতর্কতা হিসেবে আরএফ (রেডিও ফ্রিকোয়েন্সী) সিগন্যাল ডিটেক্টর বা ক্যামেরা ডিটেক্টরের মাধ্যমেও গোপন ক্যামেরা খোঁজা যেতে পারে। তবে একটা বিষয় মনে রাখা প্রয়োজন বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশেই প্রচলিত সেলফোনগুলো জিএসএম-৯০০ এবং জিএসএম-১৮০০ ব্যবহার হয়ে থাকে। জিএসএম বলতে বোঝায় গ্লোবাল সিস্টেম ফর মোবাইল। জিএসএম-৯০০ এর ক্ষেত্রে ফ্রিকোয়েন্সি ব্যান্ড সেলফোন থেকে বেইজ স্টেশনে প্রেরণ করতে ৮৯০-৯১৫ মেগা হার্টজ ও বেইজ স্টেশন থেকে সেলফোনে ডাটা গ্রহণের সময় ৯৩৫-৯১৫ মেগা হার্টজ থাকে। অপরদিকে জিএসএম-১৮০০ এর ক্ষেত্রে ফ্রিকোয়েন্সি ব্যান্ড সেলফোন থেকে বেইজ স্টেশনে পাঠাতে ১৭১০-১৭৮৫ মেগা হার্টজ ও বেইজ স্টেশন থেকে সেলফোনে ডাটা গ্রহণ করার সময় ১৮০৫-১৮৮০ মেগা হার্টজ থাকে। বিধায় গোপন ক্যামেরার ফ্রিকোয়েন্সির জন্য সেলফোনের ফ্রিকোয়েন্সি ব্লক নাও হতে পারে বা খুব একটা ইন্টারফেয়ারেন্সেরও সুযোগ নাও থাকতে পারে সেক্ষেত্রে এ পদ্ধতিতে আরএফ ফ্রিকোয়েন্সি নিয়ন্ত্রিত গোপন ক্যামেরা সনাক্ত করা সম্ভব না হওয়ার সম্ভাবনা বেশি তাই সতর্ক থাকা জরুরি;
– বর্তমান সময়ে অনেক ক্যামেরা পাওয়া যায় যা হ্যাঙ্গার, বোতাম, চশমা, পেন, হুক, জুতো, বেল্ট, টুথব্রাশ, সোপকেস, হ্যান্ড শাওয়ার ইত্যাদির মত নির্দোষ উপকরণের সাথেও স্থাপনযোগ্য তাই অধিক সতর্ক থাকা প্রয়োজন;
– বাজারে এমন কিছু স্মার্টফোন বা ক্যামেরা আছে আপনার অ্যাক্টিভিটি বা মুভমেন্ট ট্র্যাক করে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই চালু হয়ে যায় তবে চালু হওয়ার সময় আওয়াজ বা শব্দ হয় অথবা ভাইব্রেশন হয় এ বিষয়টিও খেয়াল রাখা জরুরি;
– পোশাক পরিবর্তন করে নতুন পোশাক পরিধানের পূর্বে ট্রায়াল রুমের আলো নিভিয়ে নিতে পারলে ভাল যদিও অন্ধকারে একটু অসুবিধা হলেও নিরাপদ থাকার সুযোগ থাকে। কারণ অন্ধকারে গোপন ক্যামেরা কোন ছবি বা ভিডিও নিতে পারবে না তবে ক্যামেরাটিতে নাইট ভিশন মোডের সক্ষমতা থাকলে এ পদ্ধতি সম্পর্ণরূপে ব্যর্থ হবে;
– ট্রায়াল রুমে ঢুকে যে দরজায় হ্যাঙ্গার ঝুলানো থাকে সেখানে ভাল করে দেখে নিতে হবে আবার অনেক সময় কাঠের দেয়ালের খাঁজে ক্যামেরা লুকানো থাকতে পারে এমন কিছু থাকলে সহজেই চোখে পড়বে;
– কোন বাসায় গেলে দরজাতে যেভাবে টোকা দেয়া হয় (কলিং বেল না থাকলে) ঠিক সেভাবে ট্রায়াল রুমের আয়নাতে টোকা দিয়ে দেখতে হবে সৃষ্ট শব্দটি ফাঁপা মনে হয় কিনা যদি হয় তাহলে বোঝা যাবে কোথাও ক্যামেরা লুকানো আছে;
– আয়না ভালো করে লক্ষ্য করে দেখতে হবে তার পিছনে কোনো রুম বা দেয়াল আছে কি না, যদি থাকে তাহলে বোঝা যাবে ঝামেলা আছে;
– শুধু ট্রায়াল রুম নয়, শপিং মল, দোকান বা রেস্তোরাঁর টয়লেট বা শৌচাগার ব্যবহার করলেও সচেতন হওয়া জরুরি। কেননা এসকল স্থানেও গোপন ক্যামেরার ফাঁদ থাকতে পারে;
– পার্ক কিংবা রেস্টুরেন্টে নিজেদের সংযত রাখার পাশাপাশি পরিধেয় পোশাক ঠিক আছে কিনা সে বিষয়টিতে নজর দিতে হবে, পরিহার করতে হবে মুখে বিভিন্ন এক্সপ্রেশন দিয়ে সেল্ফি তোলা থেকে সেইসাথে অপরিচিত কাউকে ছবি তুলতে না দেয়া। এমনকি ফেসবুকেও নিজের ছবিগুলো সঠিকভাবে প্রাইভেসি দিয়ে সংরক্ষণ করতে হবে তা না হলে আপনার আপলোডকৃত বিশেষ ভঙ্গির ছবি নোংরা ছবির সাথে ফটোশপের কারসাজি করে তৈরী করতে পারে ভয়াবহ বিপদ;
– জিমে যাওয়ার অভ্যাস থাকলে জিমের থভতরের বিভিন্ন জায়গা এবং ইন্সট্রুমেন্ট ব্যবহারের পূর্বে যথাযথভাবে পরীক্ষা করে নিতে হবে কোন গোপন ক্যামেরা বা মাইক্রো ফোন আছে কিনা। এমনকি আপনি যেখানে অবস্থান করে ব্যায়াম করবেন বলে ঠিক করেছেন তার আশেপাশে অন্যদের এমন কোন ব্যাগ আছে কি না যা সন্দেহজনক এবং ঐ ব্যাগের সাথে কোন ক্যামেরা বা মাইক্রোফোন ডিভাইস আছে কি না তা সতর্কতার সাথে শোভন উপায়ে পর্যবেক্ষণপূর্বক নিশ্চিত হয়ে নিতে হবে। বাজারে জিম ব্যাগ ক্যমেরা নামেই বেশ কিছু কোম্পানীর হিডেন ক্যামেরা পাওয়া যায়। বিকৃত মানসিকতার জিম ব্যবহারকারীর চশমা, হাতঘড়ি ও কলমের সাথেও থাকতে পারে ক্ষদ্র ক্যামেরা, তাই এক্ষেত্রেও প্রয়োজন অতিরিক্ত সচেতনতা;
– অনেক সময় শুভেচ্ছা জানানোর জন্য বা অভিনন্দিত করার লক্ষ্যে উপস্থাপিত ফুলের তোরার মধ্যেও থাকতে পারে ভয়ংকর ক্ষুদ্র ক্যামেরা দেখে মনে হবে ট্রায়াল রুমকে সাজানোর জন্য রাখা হয়েছে এ বিষয়টি শুধুমাত্র ট্রায়াল রুমেই নয় অন্যত্রও হতে পারে তাই সতর্কতা জরুরি;
– কখনো ট্রায়াল রুমে গিয়ে পূর্ণ পোশাক খুলে ফেলা যাবে না সম্ভব হলে পরিধেয় পোশাকের ওপরই তা পরীক্ষা করে দেখা ভালো;
গোপন ক্যামেরা বিষয়ে সবশেষ কথা সবাই সচেতন হই। বিকৃত মানসিকতার লোকদের হাত থেকে নিজেকে রক্ষার পাশাপাশি মেয়ে শিশু, কিশোরী, যুবতি, নারীসহ সকলকে রক্ষা করি কোথাও কোন গোপন ক্যামেরা আছে সন্দেহ হলে হটলাইনের মাধ্যমে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর নিকট রিপোর্ট করতে ভুল না করি। এক্ষেত্রে সচেতনতা এবং প্রতিবাদ এর কোন বিকল্প নাই।
শিশুর যৌন শিক্ষায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ কি কোন ভূমিকা রাখতে পারে? যৌন হয়রানি বা যৌন নিপীড়িত শিশু বা কিশোর-কিশোরীর প্রতি সমাজেরই বা ভূমিকা কি হতে পারে?
আমরা সকলেই জানি যে, শিশুরা দেশের ভবিষ্যত। আজকের শিশুই আগামী দিনের দেশ নায়ক। অথচ এই শিশুরাই মনে অনেক সংশয় ও ভয় নিয়ে শৈশব থেকে বেড়ে ওঠে, অতিক্রম করে কৈশোর কাল এবং পদার্পণ করে যৌবনে। তাদের শারীরিক ও মানসিক সুস্থ বিকাশে থাকা প্রয়োজন পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় সংবেদনশীলতা। কিন্তু একটা শিশু জন্মের পর থেকে পূর্ণবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত আত্মরক্ষা বা যৌনরক্ষার মতো শিক্ষা তারা সেভাবে পায় না বললেই চলে। পরিবার কিংবা স্কুল বিব্রত বোধ করে এটা জানাতে যে কিভাবে যৌন সুরক্ষা করতে হবে। যদি শিশুদেরকে সঠিকভাবে জানানো হতো তাদের শরীরের তিনটি জায়গা যেমন বুক, হিপ বা পিছনের অংশ এবং সামনে নাভির নীচের অংশ মা ছাড়া অন্য কেউ স্পর্শ করাকে যৌন নিপীড়ন বলে, তাহলে তারা সহজেই ধর্ষক ও যৌন নিপীড়ককে চিহ্নিত করার পাশাপাশি নিজেকে নিপীড়নের হাত থেকে রক্ষা করার প্রয়াস পেত। এটুকুন শিক্ষাই না থাকার কারণে শিশুরা বিশেষ করে কন্যা শিশুরা প্রতিনিয়ত যৌন নিপীড়নের শিকার হচ্ছে এবং অনেক সময় তারা বুঝতেই পারে না যে তারা নিপীড়িত বা নির্যাতিত হচ্ছে।
সাধারণত পরিবারের একটা অলিখিত উদ্দেশ্যই থাকে বাচ্চাদেরকে যৌনসংশ্লিস্ট বিষয়গুলো দূরে রাখা। তা হোক না কেন যৌন সচেতনতামূলক বিষয়, তবুও না! এর কারণ পরিবারের বড়রাও ছোটবেলা থেকে বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবে নিতে শেখে নাই এমন কি তাদের পরিবারও বিষয়টি শেখায় নাই। ফলে বর্তমানেও যৌন সংশ্লিস্ট বিষয়টি সকলের কাছেই নিষিদ্ধ বলেই গণ্য। এখন প্রশ্ন তাহলে মানুষ কোথা থেকে যৌন জ্ঞান লাভ করছে? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে ভয়াবহ চিত্র সামনে চলে আসে যেমন মানুষ কোন না কোনভাবে এটা জেনেছে, হয়ত বন্ধুবান্ধব নয়ত বিভিন্ন নোংরা ভিডিও বা অশ্লীল বই থেকে যা মানুষের মস্তিষ্কে যৌনতা নিয়ে নোংরা এবং অস্বাস্থ্যকর তথ্যই প্রদান করেছে এবং মনোজগতে সৃষ্টি করেছে ফ্যান্টাসি যা বাস্তবতা বিবর্জিত। একই ধারাবাহিকতায় কোমলমতি বাচ্চারাও একই পথ অনুসরণ করছে। বর্তমান তথ্য প্রযুক্তির যুগে নোংরা বিষয়গুলি আরও বিস্তার লাভ করেছে, পেয়েছে ব্যাপকতা। ইন্টারনেটের আশীর্বাদে এখন আর কোন কিছু লুকিয়ে রাখার সুযোগ নাই। অনেকে পরিবারই ভেবে থাকেন বাচ্চা একটু বড় হোক কিংবা কিশোর হোক তখন না হয় এসব বিষয়ে ভাবা যাবে। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরী হয়ে যায় আবার মাথায় প্রশ্ন আসে ‘এতবড় বাচ্চাকে পাশে বসিয়ে এসব নিয়ে আলাপ করব?’ আসলে কিশোর বয়সেই কেবল যৌন শিক্ষা দিতে হবে এটা জরুরি নয়। হঠাৎ করে কিশোর বয়সে এসব নিয়ে ফ্রি হতে গেলে অভিভাবক এবং বাচ্চা দুজনেরই অস্বস্তি সৃষ্টি হবে। বিষয়টি শুরুই করতে হবে বাচ্চার মস্তিষ্কের উন্নয়নের সাথে তাল মিলিয়ে। অর্থাৎ বাচ্চাকে যৌন বিষয়ে হাতে খড়ি দিতে হবে অল্প বয়স থেকেই, যেমনটা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা দেয়ার পূর্বে বাসায় শিশুদের হাতে খড়ি দিয়ে থাকেন। শিশুর বোঝার ধারণ ক্ষমতার সাথে তাল মিলিয়ে বয়সভিত্তিক যৌন শিক্ষা দিতে হবে তাকে। তাদেরকে বোঝাতে হবে যে যৌন শিক্ষা মানুষের জীবনের আর বাকি দশটা বিষয়ের মত একটা নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। কিন্তু এই বয়স ভিত্তিক যৌন শিক্ষা যে সকল পরিবারের মা-বাবা শিশুদেরকে দেন নাই সে সকল শিশুর তাহলে কি হবে?
যদিও শিশুকে যৌন শিক্ষা প্রদান পরিবারেরই কাজ এবং এটা বয়সের সাথে তাল মিলিয়ে করার কথা। সেটা যদি সময়মত না হয়ে থাকে তবে সুস্থ ও সুন্দর সমাজ গঠণের স্বার্থে তথা শিশুর মানসিক ও শারীরিক যথাযথ বিকাশ এবং উন্ন চরিত্রের অধিকারী করার লক্ষ্যে বিদ্যাপীঠকেই এ দায়িত্ব নিতে হবে। যদিও ইতিমধ্যে শিশুরা অনেক এ সংশ্লেষে নোংরা অনেক বিষয়ের সাথে জড়িয়ে যাবে উন্মুক্ত তথ্য ভান্ডার এবং উপকরণের সহজলভ্যতার কারণে। এক্ষেত্রে পরিবারের সুযোগ ছিল মূল ভূমিকা পালনের, শিশুকে যথাযথ জ্ঞান দানের পাশাপাশি তাদের সুস্থ ও সুন্দর মানসিক বিকাশে পরিবারের পরেই বিদ্যাপীঠের অবস্থান। দেখা যাক বিদ্যাপীঠ এ বিষয়ে কি কি দায়িত্ব পালন করতে পারে:
- বিদ্যালয়কে প্রথমেই ছেলে-মেয়ের শারীরিক বৈশিষ্ট্যর ভিন্নতা বিষয়ে সুন্দর এবং সাবলীল শব্দ চয়নে প্রকৃত তথ্য উপস্থাপন করতে হবে। শিক্ষার্থীর এ বিষয়ক প্রতিটা প্রশ্নেরই শালীন ও সঠিক উত্তর দিতে হবে। যদি কোন প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দিতে সমস্যা হয় তাহলে সময় চেয়ে নিয়ে আধুনিক প্রযুক্তির সার্চ ইঞ্জিন (যেমন গুগল, পিপিলীকা ইত্যাদি) ব্যবহারপূর্বক নিজে বিষয়টিতে সমৃদ্ধ হয়ে সংশ্লিষ্ট প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। মনে রাখা প্রয়োজন বাচ্চাদের উত্থাপিত কোন প্রশ্নই দমিয়ে রাখা যাবে না। তানাহলে পরবর্তীতে প্রশ্নের উত্তরের জন্য তারা অন্য কোনো অগ্রহণযোগ্য আশ্রয়স্থল খুঁজবে যা হয়ত খুবই বিপজ্জনক;
- পর্যায়ক্রমে বয়ঃসন্ধিকালীন শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তন, পিরিয়ড, ব্যক্তিগত পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা, প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার, যৌনবাহিত ও যৌনাঙ্গবাহিত রোগসহ অন্যান্য প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলো বুঝিয়ে বলতে হবে। বিষয়গুলির ব্যাখ্যা প্রদানের সময় মনে রাখতে হবে যে, বাচ্চাদের কাছে বিষয়গুলোর পরিচিতি খুবই স্বাভাবিক হয় এবং শব্দগুলো যেন তাদের নিকট সহজবোধ্য হয়। প্রয়োজনে ইন্টারনেটের প্রাসঙ্গিক শোভন ভিডিওর সহায়তা নেয়া যেতে পারে। সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বাজারে অনেক বই আছে সেগুলো একসঙ্গে পাঠ করা যেতে পারে। বাস্তবিকই সম্পূর্ণ বিষয়টি একটু দীর্ঘমেয়াদি তাই হঠাৎ করে একদিনেই কিংবা একমাসে বুঝিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করলে তা থেকে সমাজের কাঙ্খিত ফলাফল লাভের কোন সম্ভাবনা নাই বিষয়টি মনে রাখা প্রয়োজন;
- যখন বাচ্চা যৌনসংক্রান্ত বিষয়গুলোকে নিত্যদিনের অন্যান্য বিষয়ের শিক্ষার ন্যায় অনুধাবন করতে পারবে তখন তাকে প্রশ্ন করে তার জানার পরিধি বোঝার চেষ্টা করতে হবে, যেমন তার কি ধারণা শিশুরা পৃথিবীতে কিভাবে আসে। যদি তার জানার মধ্যে কোন ভুল থাকে বা শূণ্যতা থাকে তবে তাকে পরিষ্কারভাবে পুনরায় বোঝাতে হবে;
- যৌন শিক্ষা দেয়ার ক্ষেত্রে ছেলে-মেয়ে আলাদা কোনো বিষয় নয় তাই দুজনকেই একইভাবে বোঝাতে হবে। একজন ছেলে যখন মেয়েদের পিরিয়ড সম্পর্কে জানবে তখন স্বাভাবিকভাবেই চলার পথে কোনো মেয়েকে অপ্রস্তুত অবস্থায় দেখলে সম্মানের সাথে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করবে কারণ সে জানে বিষয়টি নিত্য নৈমিত্তিক এবং প্রাকৃতিক;
- শিক্ষকগণকে যথাযথ শিক্ষণ-শিখন পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে লিঙ্গ সমতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, সহমর্মিতা, পারস্পরিক অধিকার, সমতা ও ন্যায্যতা, বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক সংরক্ষণ ইত্যাদি বিষয়ক মূলবোধ জাগ্রত ও সমুন্নত রাখার প্রয়াস চালাতে হবে। প্রয়োজনে ধর্মীয়, সামাজিক, মানসিক, অর্থনৈতিক এবং বৈজ্ঞানিক বিষয়গুলোর মিথস্ক্রিয়া ঘটানো যেতে পারে।
অনেক সময়েই দেখা যায় যে বা যারা যৌন নিপীড়ন বা হয়রানির শিকার হয় তাদেরকে পরবর্তী সময়ে সামাজিক এবং পারিবারিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করা হয়। যা করা কখনোই উচিত নয় কেননা এতে করে যৌন হয়রানি বা নিপীড়নের শিকার কিছু কিছু সাহসী ছেলেমেয়ে প্রতিবাদের ভাষা হারিয়ে ফেলে এবং হীনমন্যতায় ভোগে ফলশ্রুতিতে তার স্বাভাবিক বিকাশ অধিকতর বাঁধাগ্রস্থ হয়। তাই তাদেরকে হেয় প্রতিপন্ন করে বা নেতিবাচক কথা বলে পরিবার বা সমাজ কারও উচিৎ হবে না থামিয়ে দেয়া, এট ধরনের কাজ অন্যদেরকে সাহসী হতে বাঁধা সৃষ্টি করে। যৌন নির্যাতনের শিকার শিশুদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্য প্রয়োজনে শিশুকে অবশ্যই এ বিষয়ক বিশেষজ্ঞ কাউন্সেলরের কাছে নিতে হবে। শারীরিক আঘাত থাকলে তার যথাযথ চিকিৎসা করাতে হবে। শিশুর মন মানসিকতায় ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য তার পছন্দের কোনো জায়গায় বেড়াতে নেয়া যেতে পারে। তার সঙ্গে এমন কোনো আচরণ করা যাবে না যাতে সে মনে আঘাত বা মানসিক কষ্ট পায়। ধর্ষণ বা যৌন নির্যাতনের মত ঘটনা ঘটলেও এতে তার কোন অপরাধ নাই এ বিষয়টি বড়দের আচরণে প্রকাশ করতে হবে। পারিবারিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ ও অন্যান্য কাজে শিশুকে উৎসাহ দিতে হবে। খেলাধুলার পরিবেশ তৈরি করা বা গল্পের বই পড়া বা সৃজনশীল কাজ করার সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে হবে। শিশুটির জন্য প্রয়োজনীয় আইনগত সেবা ও সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে। দীর্ঘমেয়াদি কাউন্সেলিং, পারিবারিক পারস্পরিক সহযোগিতা ও অন্যান্য সহায়তার মাধ্যমে শিশুটি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে। তবে তার জন্য অভিভাবকদের ধৈর্য ধরতে হবে এবং সমাজকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। নিপীড়ক বা নির্যাতনকারীর শাস্তি নিশ্চিতকরণের জন্য পরিবার ও সমাজকে সোচ্চার থাকতে হবে, নির্যাতনের বিষয়টি গোপন না রেখে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তা নিতে হবে যাতে সমাজে অন্য কেউ এ ধরনের ঘৃণ্য কাজ করার সাহস না পায়।
পরিবারের কোন মা বা নারী সদস্য যদি নিজেই হুমকির মধ্যে থাকেন তবে তিনি কিভাবে তার শিশুকে রক্ষা করবেন? তাই প্রত্যেক নারীদের প্রতি অনুরোধ নিজে স্বাবলম্বী এবং আত্মবিশ্বাসী হতে চেষ্টা করুন সেইসাথে নিজের আত্মসম্মানবোধকে জাগ্রত করুন। সহায় সম্বলহীন নারীদেরকে বেশিরভাগ সময় যৌন নিপীড়নের শিকার হতে হয়। বিশেষ করে দুর্বল নারীদের আশেপাশের যৌন পিপাসু মানুষ নামক প্রাণী অতিমাত্রায় নির্যাতন করার সুযোগ নেয় বা সুযোগ খোঁজে। সেইসঙ্গে সংসারে দুর্বল হওয়ার কারণে অনেক স্ত্রীকেও নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোরপূর্বক যৌন নির্যাতনের শিকার হতে হয়। নারীরা যদি আত্মবিশ্বাসী হয়, স্বাবলম্বী হয়, সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়, নিজ শিক্ষাগত যোগ্যতায় অর্থনৈতিক সক্ষমতা অর্জন করতে পারে, নিজেকে পণ্য মনে না করে, অন্যের উপর নির্ভরশীল না হয়, নিজের পরিচয়ে সমাজে পরিচিত হয় তাহলে তারা যেকোনো অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে পারবে। যারা যৌন নির্যাতন করে, তাদের চোখে চোখ রেখে এর প্রতিবাদ করতে জানতে হবে নিজ আত্মবিশ্বাসে অটল থাকতে হবে। আর এ আত্মবিশ্বাসটার গোড়া পত্তণই হয়ে থাকে পরিবারে, শিশুরা পরিবার থেকেই এটা অর্জন করে। তাই পরিবারের উচিত শিশুদের সুশিক্ষিত, স্বাবলম্বী, আত্মবিশ্বাসী এবং সাহসী হতে সাহায্য করা।
শেষ কথা, যৌন হয়রানি বা যৌন নিপীড়ন একটি মানসিক ব্যাধি যা বর্তমানে সামাজিক ব্যাধিতেও রূপান্তরিত হয়েছে। মনে রাখা প্রয়োজন যে, পরিবারই শিশুর প্রাথমিক শিক্ষা কেন্দ্র। সেখান থেকেই সচেতন করতে হবে, গড়ে তুলতে হবে প্রতিরোধ। যৌন নিপীড়ন থেকে শিশুদের বাঁচাতে হলে বা রক্ষা করতে হলে পরিবারকেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে সেইসাথে স্কুল কলেজসহ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন নিপীড়ন বিষয়ক সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। আপাত লজ্জার সামাজিক বেড়াজাল ছিন্ন করে সবাইকে খোলামেলাভাবে এইসব নিয়ে জানাতে হবে। যাতে শিশুরা নিজেদের সমস্যার কথা নিজেরাই বলতে পারে, কখনো নিপীড়িত হলে তার তীব্র প্রতিবাদ করতে পারে এবং শিশুটিও যেন ভবিষ্যতে কাউকে যৌন হয়রানি বা নিপীড়ন না করে । সুস্থ সমাজের জন্য অবশ্যই একটা সুস্থ ও সুন্দর মন মানসিকতার মানুষের প্রয়োজন, পারিবারিক পরিবেশ প্রয়োজন। বাবা-মা, সর্বজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষকমন্ডলীর চিন্তাভাবনার সামান্য পরিবর্তনই নিশ্চিত করতে পারে সমাজের ইতিবাচক উন্নয়ন। নতুন প্রজন্মের প্রতি এ গুরুদায়িত্ব সফলভাবে পালন করা গেলেই একটা সুস্থ ও সুন্দর মানবিক সমাজ এবং একটা সুরক্ষিত দেশ প্রতিষ্ঠিত করা অসম্ভব কিছু না।
সকল শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের জন্য রইল শুভকামনা এবং সকল নারীদের প্রতি রইল শ্রদ্ধা। সকলেই সুস্থ থাকুন এবং নিরাপদ থাকুন এ প্রত্যাশায় শিশুদের যৌন হয়রানি বা যৌন নিপীড়ন বিষয়ক লেখনীর সমাপ্তি টানছি।
গ্রন্থপঞ্জি:
যৌন হয়রানি বা যৌন নিপীড়ন বিষয়ক লেখনীতে যে সকল বই, আর্টিকেল, জার্নাল, কলাম, বক্তব্য, বক্তৃতা ইত্যাদি আমাকে ভাবিয়েছে এবং এ সংশ্লেষে তথ্য, জ্ঞান ও উপস্থাপনে সমৃদ্ধ করেছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি সে সকল লেখকদের প্রতি।
www.armiah.com