আন্তর্জাতিক নারী দিবস কি বেগুনী রংয়ের পোষাক এবং কেক কর্তনের মধ্যে সীমাবদ্ধ?©মোঃ আবদুর রহমান মিঞা(‘শেখ হাসিনা ইয়ুথ ভলান্টিয়ার অ্যাওয়ার্ড ২০২০’ পদকপ্রাপ্ত)

আন্তর্জাতিক নারী দিবস কি বেগুনী রংয়ের পোষাক এবং কেক কর্তনের মধ্যে সীমাবদ্ধ?©মোঃ আবদুর রহমান মিঞা(‘শেখ হাসিনা ইয়ুথ ভলান্টিয়ার অ্যাওয়ার্ড ২০২০’ পদকপ্রাপ্ত)

সারা বিশ্বে প্রতিবছর ৮ মার্চ যথাযথ মর্যাদায় ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ পালিত হয়। লিঙ্গ সমতা সম্পর্কে সমাজকে সচেতন করতেই এ দিবসের সূচনা। সমাজের সর্বস্তরে নারীর সাফল্য ও জয়গান গাওয়ার দিন আজ। কিন্তু নারী দিবস কবে থেকে পালিত হয়ে আসছে। কেনই বা নারী দিবস এতো গুরুত্বপূর্ণ?

এই দিবসটি উদযাপনের পেছনে রয়েছে নারী শ্রমিকের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের ইতিহাস। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে মজুরি বৈষম্য, কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করা, কাজের অমানবিক পরিবেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের রাস্তায় নেমেছিলেন সুতা কারখানার নারী শ্রমিকেরা। সেই মিছিলে চলে তথাকার সরকারী দমন বাহিনীর দমন-পীড়ন।

১৯০৮ খ্রিস্টাব্দে নিউইয়র্কের সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট নারী সংগঠনের পক্ষ থেকে আয়োজিত নারী সমাবেশে জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেটকিনের নেতৃত্বে সর্বপ্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন হলো। ক্লারা ছিলেন জার্মান রাজনীতিবিদ; জার্মান কমিউনিস্ট পার্টির স্থপতিদের একজন। এরপর ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন। ১৭টি দেশ থেকে ১০০ জন নারী প্রতিনিধি এতে যোগ দিয়েছিলেন।

এ সম্মেলনে ক্লারা প্রতি বৎসর ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে পালন করার প্রস্তাব দেন। সিদ্ধান্ত হয় ১৯১১ খ্রিস্টাব্দ থেকে নারীদের সম-অধিকার দিবস হিসেবে দিনটি পালিত হবে। দিবসটি পালনে এগিয়ে আসে বিভিন্ন দেশের সমাজতন্ত্রীরা। ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দ থেকে বেশ কয়েকটি দেশে ৮ মার্চ পালিত হতে লাগল।

অতঃপর জাতিসংঘ ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। দিবসটি পালনের জন্য বিভিন্ন রাষ্ট্রকে আহ্বান জানায় জাতিসংঘ। এরপর থেকে সারা পৃথিবী জুড়েই পালিত হচ্ছে দিনটি নারীর সমঅধিকার আদায়ের প্রত্যয় নিয়ে।১৯০৯ সালে নিউ ইয়র্কের সোশ্যালিস্ট পার্টি রাজনৈতিকভাবে প্রথম পালন করে দিবসটি। পরে ১৯১৭ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ৮ মার্চ জাতীয় ছুটি ঘোষণা করে। নারীর ক্রমবর্ধমান সচেতনতা এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর অধিকার অর্জনের লক্ষ্যে নারী দিবস অন্য সব দিবসের সঙ্গে গোটা বিশ্বেই পালিত হয়ে আসছে।

জাতিসংঘ ২০২২ সালের নারী দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে ‘নারীর সুস্বাস্থ্য ও জাগরণ’। এই মূল প্রতিপাদ্যের আলোকে বাংলাদেশের মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবছর আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে- ‘টেকসই আগামীর জন্য, জেন্ডার সমতাই আজ অগ্রগণ্য’। আমরা যদি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ১৯(৩) অনুচ্ছেদের প্রতি দৃষ্টি দেই তবে সেখানেও দেখা যায় যে, জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে মহিলাদের অংশগ্রহণ ও সুযোগের সমতা রাষ্ট্র কর্তৃক নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে।

আর এই বিশেষ দিনটির সঙ্গে লুকিয়ে আছে বেগুনি রং। তবে নারী দিবসের রং বেগুনি কেন বা কােথা থেকে এই রং প্রতীক হিসেবে নির্ধারিত হলো তার পেছনে অনেক জানা-অজানা কথা রয়েছে।

২০১৮ সাল থেকে নারী দিবসের থিম কালার হিসেবে স্থান করে নিয়েছে বেগুনি।

সে বছর আন্তার্জাতিক প্রতিষ্ঠান প্যান্টন বেগুনি রংকে নারী দিবসের রং হিসেবে ঘোষণা দেয়। এই বেগুনি দিয়ে সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মিকে বোঝানো হয়। আর নারীরা হবে ঠিক অতিবেগুনি রশ্মির মতাে শক্তিশালী।

বেগুনি রংকে কেন নারী দিবসের রং করা হলো সে বিষয়ে প্যান্টন জানায়, বেগুনি রং দিয়ে দুরদর্শী চিন্তাভাবনাকে বোঝানো হয়, বেগুনি দিয়ে ভবিষ্যতের রংকে বোঝানো হয়। সেই সাথে লিঙ্গ সমতাকে বোঝানো হয় বেগুনি রঙের মাধ্যমে, যার জন্য আজও নারীরা যুদ্ধ করে যাচ্ছে।

বিংশ শতাব্দীর শুরুতে নিজেদের ভোটাধিকার আদায়ের লক্ষ্যে সাদা ও সবুজ রংকে নারী দিবসের রং হিসেবে ব্যবহার করতেন বিট্রেনের নারীরা। তাদের মতে সাদা শুদ্ধতা ও সবুজ আশার প্রতীক।

বেগুনি যে নারীমুক্তি আন্দোলনেরও রং ছিল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। নারীরা সমাজের জন্য লড়াই করছে, এ বিষয়টি কোনো রং দিয়ে বোঝাতে চাইলে তখন উপযুক্ত রং হলো বেগুনি।

বেগুনি রং হলো অর্জনের প্রতীক। আর এই বেগুনি পরেই নারী সামনে এগিয়ে যাবে, পথকে করে তুলবে মসৃণ। বৈষম্য ভেদ করে নারীরা অতিবেগুনি রশ্মিও পার করবে এটাই কাম্য।

একদিনের জন্য নারী দিবস পালনে করে নারীদের অধিকার সুসংহত বা সুরক্ষা করা যাবে কি? যেখানে এখনো অনেক নারী সমাজে পরিচিত হয় ‘অমুকের মা’ বা ‘অমুকের মেয়ে’ বা ‘অমুকের বউ’, সম্মাণিত নারীগণকে এ বিষয়টি ভেবে দেখার জন্য অনুরোধ থাকল। আন্তর্জাতিক নারী দিবসের মাধ্যমে হয়ত বড়জোর নারীকে তাদের নিজের সম্পর্কে সংবেদনশীল করা যেতে পারে। নারীরা যদি আত্মবিশ্বাসী হয়, স্বাবলম্বী হয়, সুশিক্ষায় শিক্ষিত হয়, নিজ শিক্ষাগত যোগ্যতায় অর্থনৈতিক সক্ষমতা অর্জন করতে পারে, নিজেকে পণ্য মনে না করে, কালো রং সাদা করা বা সাদাকে আরও সাদা করার আপাত ম্যাজিক কসমেটিক্সের পিছনে না ছুটে বা বিউটি পার্লারমুখী না হয়ে নিজের মেধা ও মননের প্রতি মনোনিবেশ করে, অন্যের উপর নির্ভরশীল না হয়ে স্বাবলম্বী হয়, নিজের পরিচয়ে সমাজে পরিচিত হয় তাহলে তারা যেকোনো অন্যায়ের প্রতিবাদ করার পাশাপাশি নিজের অধিকার আদায়ে সক্ষম হবে, সক্ষম হবে নিজস্ব ক্ষমতায়নে।

নারীকেই নারীর জায়গা তৈরি করে নিতে হবে, অন্য কারো অনুকম্পা বা দয়ায় নয়। নারী যদি নিজে সোচ্চার না হয় বা নিজেকে যোগ্য করে না তোলে তবে তার অধিকার বা ক্ষমতায়ন বেগুনী রংয়ের শাড়ী বা পোষাক এবং কেক কাটার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে।

মা-বোন, নারী সহপাঠী-সহকর্মীসহ সকল শ্রদ্ধেয় ও সম্মাণিত নারীগণকে বিষয়টি ভেবে দেখার জন্য অনুরোধ থাকল।

সকল নারীর জন্য রইল নিরন্তর শুভকামনা।