৩২তম আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস

৩২তম আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস

– ©মোঃ আবদুর রহমান মিঞা (‘শেখ হাসিনা ইয়ুথ ভলান্টিয়ার অ্যাওয়ার্ড ২০২০’ পদকপ্রাপ্ত)

Gerontology and Geriatric Welfare (GGW) এর শিক্ষার্থী

১৯৯০ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক প্রতি বছর ১ অক্টোবর আন্তর্জাতিকভাবে প্রবীণ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছিল এবং ১৯৯১ সাল থেকে দিবসটি আনুষ্ঠানিকভাবে পালন শুরু হয়। প্রবীণদের সুরক্ষা এবং অধিকার নিশ্চিতের পাশাপাশি বার্ধক্যের বিষয়ে বিশ্বব্যাপী গণসচেতনতা সৃষ্টিই দিবসটি পালনের মূল লক্ষ্য।

জাতিসংঘ এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের নাগরিকদের জন্য ৬০ বছর ও তদুর্ধ্ব এবং উন্নত দেশগুলোর নাগরিকদের জন্য ৬৫ বছর ও তদুর্ধ্ব বয়সীদের প্রবীণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ব্যাপক উন্নতি, সচেতনতা, পুষ্টি ও স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন মৃত্যুহার যেমন হ্রাস করেছে; পাশাপাশি মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে। ফলে বিশ্ব সমাজে বয়স্কদের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে।

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রবীণ নাগরিকদের সামাজিক নিরাপত্তা বিধানের লক্ষ্যে বাংলাদেশের সংবিধানে সামাজিক নিরাপত্তা সংক্রান্ত ১৫(ঘ) অনুচ্ছেদ সংযুক্ত করেন। এ ধারাবাহিকতায় সাংবিধানিক অঙ্গীকার প্রতিপালনের জন্য সরকার ১৯৯৬ সালে প্রবীণ ব্যক্তিদের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় আনতে বয়স্ক ভাতা কর্মসূচি প্রবর্তন করে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বর্তমানে বাংলাদেশে প্রায় দেড় কোটিরও অধিক প্রবীণ বা সিনিয়র সিটিজেন রয়েছেন। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী ২০৫০ সাল নাগাদ দেশে প্রবীণের সংখ্যা সাড়ে তিন কোটি ছাড়িয়ে যাবে। ২০৫০ সালে বাংলাদেশে প্রতি পাঁচজনে একজন প্রবীণ হবেন,যা ওই সময়ের জনসংখ্যার ২০ শতাংশ।

বাংলাদেশে আগামী ২০৫০ সালে শিশুর চেয়ে প্রবীণ নাগরিকের সংখ্যা এক শতাংশ বেশি হবে। ওই সময় শিশুর সংখ্যা হবে ১৯ শতাংশ এবং প্রবীণ নাগরিকের সংখ্যা হবে ২০ শতাংশ। সরকার ২০১৪ সালে প্রবীণ ব্যক্তিদের সিনিয়র সিটিজেন হিসেবে ঘোষণা করেছে, প্রবীণদের সুরক্ষায় ‘পিতা-মাতার ভরণপোষণ আইন ২০১৩’, ‘জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা-২০১৩’ এবং জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে জাতীয় কর্মপরিকল্পনা-২০১৫ প্রণয়ন করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে প্রবীণদের জন্য আয় সৃষ্টিকারী কার্যক্রম গ্রহণ, তৃণমূল পর্যায়ে তাদের স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারণ এবং হাসপাতাল, বিমানবন্দরসহ বিভিন্ন স্থাপনা ও যানবাহনকে প্রবীণবান্ধব করে গড়ে তোলা হচ্ছে।

২০০২ সালে মাদ্রিদে অনুষ্টিত ১৫৯টি দেশের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে প্রবীন বিষয়ক দ্বিতীয় বিশ্ব সম্মেলনে একটি আন্তর্জাতিক কর্ম পরিকল্পনা ও রাজনৈতিক ঘোষণা গৃহীত হয়। এতে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে ‘সকল বয়সীদের জন্য উপযুক্ত একটি সমাজ নির্মাণের জন্য উন্নয়নের অধিকার, মৌলিক স্বাধীনতা ও সকল ধরনের মানবাধিকার রক্ষা ও উন্নয়ন খুবই প্রয়োজন।’ এই সম্মেলনে যে এগারোটি বিষয়ের ওপর গূরুত্ব আরোপ করা হয় সেগুলো হচ্ছে:

(১) সকল প্রবীণ নাগরিকের মৌলিক স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের পূর্ণ বাস্তবায়ন;

(২) নিরাপদ বার্ধক্য অর্জন এবং প্রবীণ বয়সে দারিদ্র দূরীকরণ এবং প্রবীণদের জন্য জাতিসংঘ নীতিমালা বাস্তবায়ন;

(৩) নিজেদের সমাজে স্বেচ্ছামূলক কাজ ও আয় বর্ধকমূলক কাজের মাধ্যমে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনযাপনে পরিপূর্ণ ও কার্যকরভাবে অংশগ্রহণ করার জন্য প্রবীনদের ক্ষমতায়ন;

(৪) জীবনব্যাপি এবং শেষ জীবনেও স্বচ্ছল, আত্মপরিতৃপ্তি ও ব্যক্তিগত উন্নয়নে সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে;

(৫) প্রবীণরা কোনও একক সমজাতীয় বর্গ নয়– বিষয়টি স্বীকার করে তাদের জীবনব্যাপি শিক্ষা ও কমিউনিটি অংশগ্রহণের সুযোগ;

(৬) প্রবীণরা যেন অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকার এবং ব্যক্তির নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার নিশ্চিত এবং তার বিরুদ্ধে সকল বৈষম্য ও সন্ত্রাস দূর করতে হবে;

(৭) জেন্ডার ভিত্তিক বৈষম্য দূর করে প্রবীণদের মধ্যে জেন্ডার সাম্য প্রতিষ্ঠা করার অঙ্গীকার;

(৮) সামাজিক উন্নয়নের জন্য পারস্পরিক সংহতি, আন্ত:প্রজন্ম নির্ভরশীলতা ও পরিবারে স্বীকৃতি প্রদান;

(৯) প্রতিরোধ ও পুনর্বাসনমূলক স্বাস্থ্যসেবা, সহায়তা এবং সামাজিক নিরাপত্তার সুযোগ থাকা;

(১০) প্রবীনদের মধ্যে প্রাইভেট সেক্টর, সিভিল সোসাইটি ও সরকারের সব মহলের মধ্যে অংশীদারিত্ব গড়ে তোলার সহযোগিতা;

(১১) উন্নয়নশীল দেশসমূহে অন্যান্যের মধ্যে বার্ধক্যের ব্যক্তিকর, সামাজিক ও স্বাস্থ্যগত প্রতিক্রিয়াগুলো কেন্দ্র করে যন্ত্রপাতি আবিষ্কারসহ বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে উৎসাহ প্রদান;

(১২) আদিবাসী প্রবীণদের বিশেষ পরিস্থিতি ও অন্যান্য পারিপার্শ্বিকতা বিবেচনায় রেখে তাদের বক্তব্য কার্যকরভাবে প্রকাশের সুযোগ দেয়া।

এই সম্মেলনে যে তিনটি নির্দেশনা কার্যকর করতে বলা হয়েছে সেগুলো হলো:

(ক) প্রবীণ জনগোষ্ঠী ও উন্নয়ন;

(খ) প্রবীণদের স্বাস্থ্য ও স্বচ্ছলতা বৃদ্ধি; এবং

(গ) প্রবীণদের জন্য সক্ষমতা ও সহায়তামূলক পরিবেশ নিশ্চিত করা।

আলোচ্য সম্মেলনে ২৩৯টি সুপারিশ সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রাক্কালে ২০২২ সালের এবং ৩২ তম আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবসের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে:

পরিবর্তনশীল বিশ্বে বয়স্ক ব্যক্তিদের সহনশীলতা অর্থাৎ Resilience of Older Persons in a Changing World’

বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি পেয়ে ৭২.৪ বছরে উন্নীত হয়েছে এবং একই সাথে বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রবীণ ব্যক্তির সংখ্যা। বর্তমানে বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার ৯ শতাংশের অধিক প্রবীণ। আইএলও কর্তৃক প্রকাশিত ‘ওয়ার্ল্ড সোশ্যাল প্রটেকশন রিপোর্ট ২০২১-২২’ অনুযায়ী ২৮.৪ শতাংশ মানুষকে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতাভুক্ত করে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে, যার মধ্যে উল্লেযোগ্য প্রবীণ জনগোষ্ঠীও অন্তর্ভুক্ত।

চলমান চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সঙ্গে ব্যাপক বিস্তৃতি লাভ করছে উন্নত ডিজিটাল প্রযুক্তির উদ্ভাবন। যা মানবজীবনে বেঁচে থাকার ধরন, কাজ করার কৌশলসহ সবকিছুতে এসেছে নাটকীয় পরিবর্তন। টেকসই উন্নয়নের জন্য এ এক অভূতপূর্ব মাইলফলক। প্রবীণদের ক্ষেত্রে ডিজিটাল নির্ভর দৈনন্দিন কাজ তাদের জন্য জীবনটাকে করে দিতে পারে আরও সহজ ও আকর্ষণীয়। বিশেষ করে যেসকল ক্ষেত্রে গৃহে প্রবীণ একেই থাকেন বা শুধুমাত্র স্বামী-স্ত্রী, সে সকল গৃহে বা পরিবারে প্রযুক্তির ব্যবহার তাঁদের জীবনকে করে তুলে অধিকতর চিত্তাকর্ষক ও আরামদায়ক। উপরন্তু ডিজিটাল পরিষেবার মাধ্যমে ডিজিটাল পেমেন্ট গেটওয়ে ব্যবহারপূর্বক ইউটিলিটি বিল পরিশোধ, অনলাইন লার্নিং বা ইউটিউবের ব্যবহারিক লার্নিং, টেলিমেডিসিন সেবা গ্রহণ, অনলাইন শপিং, অ্যাম্বুলেন্স সহায়তা থেকে শুরু করে দৈনন্দিন কাজে সহায়তাকারীর সহায়তা গ্রহণ ইত্যাদি তৃতীয় পক্ষের সহায়তা ব্যতীতই নিমিষেই সম্ভব।

প্রযুক্তি বান্ধব প্রবীণ সহজে অন্যের উপর নির্ভরশীলতা অনেকাংশেই হ্রাস করতে পারেন অবলীলায়। বিধায় প্রবীণদের প্রযুক্তির আওতাভূক্ত করার পাশাপাশি প্রযুক্তি ব্যবহার উপযোগী করার লক্ষ্যে সরকারী-বেসরকারীভাবে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। কেননা সমাজ তথা দেশের যেকোন দূর্যোগ বা দূর্ঘটনা কিংবা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ বা তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ গ্রহণে প্রবীণের বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা অধিকতর গুরুত্ব বহন করে। কারণ, সারা বিশ্বেই প্রবীণদের অবদান রাখার সম্ভাবনা বিপুল। তাই তাঁদেরকে আধুনিক প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে অনেক মূল্যবান মানব সম্পদে পরিণত করে পরামর্শক বা উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করার সুযোগ তৈরি করে দেয়া যেতে পারে। এ ধরণের পরামর্শক বা উপদেষ্টা চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের দক্ষতা হিসেবেও বিবেচ্য। যা পরিবর্তণশীল বিশ্বে প্রবীণদের সহনশীলতার বড় একটি ধনাত্মক প্রভাবক হিসেবেও কাজ করবে বলে প্রতীয়মান হয়।

প্রবীণ শব্দটি উচ্চারণ করা মাত্রই মানস চোখে যে দৃশ্যপট ভেসে উঠে তাহলো একজন ত্বক কুঁচকানো ও শুভ্রকেশধারী মানুষ যিনি বয়সের ভারে ন্যূজ্ব এবং বার্ধক্যজনিত অসুস্থতায় জর্জরিত। কেউ কেউ অত্যন্ত অসহায়ভাবে জীবন যাপন করে থাকেন। আমরা তাদের সম্মান মর্যাদা কতখানি দিয়ে থাকি জানি না, তবে অযত্ন-অবহেলা ও উপেক্ষা করতে পারলে যেন বেঁচে যাই। মনে করে থাকি বৃদ্ধ আর ক’দিন বাঁচবে? তার জন্য সময় নষ্ট করার দরকার কী? এটা কখনও মনে হয় না বেঁচে থাকলে আমাদেরও অবস্থা এমনটাই হবে। প্রবীণদের প্রতি তরুণ প্রজন্মের অসম্মান কখনও বাঙালির মূল্যবোধ হতে পারে না। আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে তাদের সম্মান করা, শ্রদ্ধা করা, মর্যাদা দেয়া ও সহায়তা করা আমাদের জন্য বাধ্যতামূলক দায়িত্ব ও কর্তব্য।

প্রবীণরা অভিজ্ঞতার সম্পদ, আমাদের কাছে উজ্জীবনী শক্তি হিসেবে চলমান ইতিহাস এবং ভবিষ্যতের পথপ্রদর্শক। তাঁরা যেন সম্মান আর মর্যাদার সঙ্গে বাঁচতে পারেন আর সমাজে নাগরিক হিসেবে পূর্ণ অধিকার নিয়ে অংশগ্রহণ করতে পারেন, সে বিষয়টি নিশ্চিতকরণ জরুরি। মনে রাখা প্রয়োজন প্রবীণদের অবস্থা পরিবার আর সমাজে বটবৃক্ষের মতো।

তথ্যসূত্র:

রহমান মিঞা, মোঃ আবদুর, “চতুর্থ শিল্পবিপ্লব: প্রস্তুতির এখনই সময়”, মৃত্তিকা প্রকাশন, ঢাকা, ডিসেম্বর ২০২১.

https://www.rtvonline.com/bangladesh/
https://www.google.com/search?q
https://msw.gov.bd/sites/default/files/files/msw
https://www.jugantor.com/todays-paper/
https://www.banglatribune.com/370113/