চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস ও টেকসই উন্নয়ন

চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস ও টেকসই উন্নয়ন

– ©মোঃ আবদুর রহমান মিঞা (‘শেখ হাসিনা ইয়ুথ ভলান্টিয়ার অ্যাওয়ার্ড ২০২০’ পদকপ্রাপ্ত)

Clinical Social Work (CSW) ও Gerontology and Geriatric Welfare (GGW) এর শিক্ষার্থী

১০ অক্টোবর বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস হল, পৃথিবীর সকলের মানসিক স্বাস্থ্য শিক্ষা ও সচেতনতার দিন। ১৯৯২ সালে প্রথমবার এই দিনটি পালন করা হয়েছিল। তখন থেকে প্রতি বছরই ১০ অক্টোবর দিনটিতে আন্তর্জাতিকভাবে মানসিক স্বাস্থ্য দিবস হিসেবে পালন করা হয়। অনেক দেশে মানসিক রোগ সচেতনতা সপ্তাহের অংশ হিসেবেও পালন করে থাকে। এর মূল লক্ষ্যই হল, সর্ব সাধারণকে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা সম্পর্কে সচেতন ও শিক্ষিত করা।

বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবসের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, ১৯৯২ সালের ১০ ই অক্টোবর তৎকালীন উপ-মহাসচিব রিচার্ড হান্টার, ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অফ মেন্টাল হেলথ (ডব্লিউএফএমএইচ) প্রথম এই দিবস পালন করা শুরু করেন। ১৯৯৪ সালে ডব্লিউএফএমএইচ এর ভূতপূর্ব সেক্রেটারি জেনারেল ইউজিন ব্রোডি একটি থিমের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যা ছিল ‘বিশ্বজুড়ে মানসিক স্বাস্থ্য সেবার মান উন্নত করা’। তিন বছরের মধ্যে, এ দিনটি সরকারী বিভাগ ও সংস্থার কাছে মানসিক স্বাস্থ্য সেবা সম্পর্কিত দিকগুলিতে গুরুত্ব প্রদানের জন্য উল্লেখযোগ্য একটি দিন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ১৯৯৫ সালে এ দিনটিতে আন্তর্জাতিক ইভেন্টগুলি ব্যাপক আনুষ্ঠানিকতার সাথে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। তারপর থেকেই বিশ্বজুড়ে এ দিবসটি নিয়মিত পালিত হয়ে আসছে। বিশ্বের অনেক দেশে, এই দিবস সংক্রান্ত বিভিন্ন অনুষ্ঠানগুলি বেশ কয়েক দিন বা সপ্তাহ যাবৎ উদযাপিত হয়, যেমন- অস্ট্রেলিয়ায় ‘মানসিক স্বাস্থ্য সপ্তাহ’ পালন করা হয়। ১০০-টিরও বেশি দেশে বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবসের অনুষ্ঠান আনুষ্ঠানিকভাবে পালন করা হয়। ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অফ মেন্টাল হেলথ বিশ্বজুড়ে মানুষের কাছে মানসিক স্বাস্থ্যের প্রচার করছে এবং মানসিক অসুস্থতার ধরণ সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করে চলেছে।

মানসিক স্বাস্থ্য বলতে মানসিকভাবে ব্যক্তির সুস্থতাকে বোঝায়। একজন ব্যক্তি যখন চারপাশের সব সুশৃঙ্খলতা বা বিশৃঙ্খলতা দেখার পর নিজেকে সুন্দর, সুস্থ ও দেশের সুনাগরিক হিসেবে পরিচিত করাতে পারে, তখন তাকে একজন সুস্থ মানুষ হিসেবে গণ্য করা হয়। 

যখন একজন মানুষ সুস্থ থাকে তখন পারিবারিক সামাজিক ও কর্মক্ষেত্রে সে ব্যক্তিগত সন্তুষ্টির সঙ্গে সঙ্গে সবার সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারে এবং আস্থাভাজন হতে পারে। অর্থাৎ মানসিক স্বাস্থ্য বলতে শারীরিক, মানসিক ও নৈতিক এই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের মিথস্ক্রিয়ার আত্মোন্নয়নমূলক জীবনের প্রতিশ্রুতি। 

বেশীদিন পূর্বের কথা নয় যখন মানসিক স্বাস্থ্য ভাল না থাকলেই তাকে ‘মাথার সমস্যা’ বা ‘জ্বিন-ভুতের আছর’ বলে চিহ্নিত করা হত। আসলে শরীরের মতো মনেরও যে অসুখ করতে পারে, এই বিষয়টা সহজভাবে নেয়াই হতনা। মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতনতা যাতে আরও ছড়িয়ে পড়ে তার জন্যই সারা পৃথিবী জুড়ে বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস পালন করা হয়।

মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি আরও বেশি আলোচনায় উঠে আসে করোনা অতিমারির সময়। অতিমারির ‘নিউনর্মাল’ পরিবেশে মানিয়ে নিতে কম-বেশি সকলকেই বেগ পেতে হয়েছে। নানা রকম প্রতিকূলতার সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে বিপর্যস্ত হয়েছে মানসিক স্বাস্থ্যও।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বিগত কয়েক বছরে মানুষ অনেক বেশি পরিমাণে মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্বও উপলব্ধি করতে শুরু করেছেন। তাদের পরিসংখ্যান বলছে, পৃথিবীতে মৃত্যুর দ্বিতীয় বৃহত্তম কারণ আত্মহত্যা। অবসাদের কারণে পনের থেকে উনত্রিশ বছর বয়সী ছেলে-মেয়েরা বেছে নিচ্ছে এ বিধ্বংসী পথ। একই সংস্থার তথ্যমতে, প্রতি ৪০ সেকেন্ডের মধ্যে সারাবিশ্বে কেউ না কেউ আত্মহত্যার মাধ্যমে প্রাণ বিসর্জন দেয়। আত্মহত্যাজনিত মৃত্যুর অধিকাংশই প্রতিরোধযোগ্য বেশীরভাগই আত্মহত্যার সময় কোনো না কোনো মানসিক রোগে আক্রান্ত থাকেন। সাধারণত সেটা গুরুত্ব দেয়া হয় না বা মানসিক রোগ নিশ্চিত হলেও যথাযথ চিকিৎসা করা হয় না বলেই আত্মহত্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। মানসিক সুস্বাস্থ্য নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে আত্মহত্যার হার হ্রাস করা সম্ভব।

মানসিক রোগে আক্রান্ত বেশিরভাগই ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক অবহেলা ও বৈষম্যের শিকার। এর প্রধান কারণ মানসিক স্বাস্থ্য রোগ ও এর চিকিৎসার প্রতি জনগণের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। মানসিক রোগ ও এর চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সমাজে মর্যাদাবোধের অভাব লক্ষ্য করা যায়। এজন্য অনেকে মানসিক রোগের চিকিৎসা নেয়াকে সামাজিকভাবে লজ্জাকর মনে করেন, যেটি শারীরিক রোগের ক্ষেত্রে দেখা যায় না। কিছু সেবা প্রাপ্তির ক্ষেত্রেও অনেক সময় রোগী ও পারিবারের সদস্যগণ খারাপ আচরণের শিকার হন। এজন্য পারিবারিক শ্রদ্ধাবোধ বজায় রাখা জরুরি।

মানসিক স্বাস্থ্যে মর্যাদাবোধ বিষয়টি শুধুমাত্র রোগ নির্ণয় থেকে শুরু করে চিকিৎসা, পুনর্বাসন ও নিরাময় প্রক্রিয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এর অর্থ ব্যাপক। মানসিক রোগীর ক্ষেত্রে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন ও বিশেষ ক্ষেত্রে ব্যতীত জোরপূর্বক আটকে রাখা মর্যাদাহানি, নিম্নমানের সেবা, সঠিক সময়ে চিকিৎসা যা পাওয়া এসব বিষয় মর্যাদার সংঙ্গে জড়িত। এ বিষয়টির প্রতি লক্ষ্য রেখে মানসিক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির দ্রুত রোগ নির্ণয় করে তাকে বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা আমাদের নৈতিক ও সামাজিক দায়িত্ব।

সুস্থ শরীর ছাড়া যেমন সুস্থ মন সম্ভব নয়, তেমনি সুস্থ মন ছাড়া সুস্থ শরীর ও সুস্থ জীবন কোনভাবেই সম্ভব নয়। চিকিৎসার পাশাপাশি মানসিক রোগীকে পারিবারিক ও সামাজিক সমর্থন দেয়া খুবই জরুরি। অন্যান্য রোগের ন্যায় মানসিক রোগেরও আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা রয়েছে। ঝাড়ফুক বা অবৈজ্ঞানিক চিকিৎসা পদ্ধতি পরিহারে জনগণের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। শারীরিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়ন উন্নত জীবন ও সুখী সমৃদ্ধ দেশ গড়ার জন্য অপরিহার্য।

বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবসকে কেন্দ্র করে প্রতিবছর একটা থিম বা প্রতিপাদ্য থাকে, এবছরের প্রতিপাদ্যঅর্থাৎ বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস ২০২২ সালের থিম বা মুল প্রতিপাদ্য হল:

‘Make mental health & well-being for all a global priority অর্থাৎ সবার মানসিক স্বাস্থ্য ও ভালো থাকাটাই হোক বৈশ্বিক অগ্রাধিকার’।

শুরুর দিকে কোনও নির্দিষ্ট থিম বা প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল না, সাধারণভাবে এটি মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিষয়ে প্রচার করা হত। এ পর্যন্ত এ দিবসের জন্য ব্যবহৃত থিমগুলি হল-

১) ১৯৯৪ সালে ‘বিশ্বব্যাপী মানসিক স্বাস্থ্য সেবার মান উন্নত করা’;

২) ১৯৯৬ সালে ‘নারী ও মানসিক স্বাস্থ্য’;

৩) ১৯৯৭ সালে ‘শিশু ও মানসিক স্বাস্থ্য’;

৪) ১৯৯৮ সালে ‘মানসিক স্বাস্থ্য ও মানবাধিকার’;

৫) ১৯৯৯ সালে ‘বয়স্কদের মানসিক স্বাস্থ্য’;

৬) ২০০০-২০০১ সালে ‘মানসিক স্বাস্থ্য ও কর্ম’;

৭) ২০০২ সালে ‘শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের উপর মানসিক আঘাত এবং হিংস্রতার প্রভাব’;

৮) ২০০৩ সালে ‘শিশু এবং কিশোর-কিশোরীদের মানসিক এবং আচরণগত ব্যাধি’;

৯) ২০০৪ সালে ‘শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের মধ্যে সম্পর্ক: সহ-সংঘটিত ব্যাধি’

১০) ২০০৫ সালে ‘সারাজীবন জুড়ে মানসিক এবং শারীরিক স্বাস্থ্য’;

১১) ২০০৬ সালে ‘মানসিক অসুস্থতা এবং আত্মহত্যার ঝুঁকি হ্রাস’;

১২) ২০০৭ সালে ‘পরিবর্তিত বিশ্বে মানসিক স্বাস্থ্য: সংস্কৃতি ও বৈচিত্র্যের প্রভাব’;

১৩) ২০০৮ সালে ‘মানসিক স্বাস্থ্যকে অগ্রাধিকার প্রদান’;

১৪) ২০০৯ সালে ‘চিকিৎসা বাড়ানো এবং মানসিক স্বাস্থ্যের প্রচার’;

১৫) ২০১০ সালে ‘মানসিক স্বাস্থ্য এবং দীর্ঘস্থায়ী শারীরিক অসুস্থতা’;

১৬) ২০১১ সালে ‘দ্য গ্রেট পুশ: মানসিক স্বাস্থ্যে বিনিয়োগ’;

১৭) ২০১২ সালে ‘ডিপ্রেশন: একটি বিশ্ব সংকট’;

১৮) ২০১৩ সালে ‘মানসিক স্বাস্থ্য এবং প্রাপ্তবয়স্ক’;

১৯) ২০১৪ সালে ‘সিজোফ্রেনিয়ার সাথে বসবাস করা’;

২০) ২০১৫ সালে ‘মানসিক স্বাস্থ্যে গৌরব’;

২১) ২০১৬ সালে ‘মনস্তাত্ত্বিক এবং মানসিক স্বাস্থ্য প্রাথমিক চিকিৎসা’;

২২) ২০১৭ সালে ‘কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্য’;

২৩) ২০১৮ সালে ‘পরিবর্তিত বিশ্বে তরুণ এবং মানসিক স্বাস্থ্য’;

২৪) ২০১৯ সালে ‘মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়ন ও আত্মহত্যা প্রতিরোধ’;

২৫) ২০২০ সালে ‘সবার জন্য মানসিক স্বাস্থ্য: অধিক বিনিয়োগ, অবাধ সুযোগ’;

২৬) ২০২১ সালে ‘অসম বিশ্বে মানসিক স্বাস্থ্য’;

২৭) ২০২২ সালে ‘Make mental health & well-being for all a global priority অর্থাৎ সবার মানসিক স্বাস্থ্য ও ভালো থাকাটাই হোক বৈশ্বিক অগ্রাধিকার’।

সারা বিশ্বে মানসিক রোগে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। মহামারিকালের বিধিনিষেধে মানসিক স্বাস্থ্য যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। পাশাপাশি চিকিৎসাপদ্ধতিও উল্লেখ করার মতো উন্নত হয়েছে। তবে সচেতনতার অভাবে মানসিক রোগ ও রোগীর প্রতি নেতিবাচক মনোভাব এখনো জোরালোভাবে বিদ্যমান। এ জন্য অনেক সময় রোগী অবহেলার শিকার হয় এবং সঠিক চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হয়।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের প্রতিবেদন অনুসারে বাংলাদেশে মানসিক রোগের প্রাদুর্ভাব সতের শতাংশ, যার তুলনায় যোগ্যতাসম্পন্ন মানসিক স্বাস্থ্য পেশাজীবীর সংখ্যা ভয়াবহভাবে কম। বাংলাদেশে মানসিক স্বাস্থ্য পেশাজীবীদের মধ্যে আছেন সাইকিয়াট্রিস্ট (মানসিক বা মনোরোগ চিকিৎসক), ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট ও কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট এবং অন্যান্য মানসিক স্বাস্থ্যসেবা কর্মী। তুলনামূলকভাবে অনেক কম ও শহরকেন্দ্রিক চিকিৎসা ব্যবস্থা হওয়াতে মানুষ প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা নিতে ব্যর্থ হন।

 

মানসিক রোগীদের বিশাল একটা অংশ সুস্থ হওয়ার আশায় (মেডিকেল চিকিৎসার বাইরে) নানা রকম অপচিকিৎসার আশ্রয় নেয়। এতে রোগী দীর্ঘদিন ধরে ভুগতে থাকে। নানা জায়গায় প্রচুর টাকাপয়সা অপচয় করে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে একটা সময় তারা হতাশ হয়ে যায়, হাল ছেড়ে দেয়, আবার কেউ কেউ শেষ চেষ্টা হিসেবে চিকিৎসা নেয়া শুরু করে। কিন্তু ততক্ষণে রোগের জটিলতা ব্যাপক বৃদ্ধি পায় ও উন্নততর চিকিৎসার আর্থিক সংগতিও থাকে না। ফলে সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনাও কমে আসে। সময়মতো রোগের লক্ষণ নির্ণয় করে তার সঠিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করা অত্যন্ত জরুরি। যেন আক্রান্ত ব্যক্তি মানসিক রোগের কষ্ট ও ভয়াবহতা থেকে বের হয়ে আসতে পারে। মানসিক রোগ শারীরিক রোগের মতোই একধরনের রোগ। শারীরিক রোগের মতোই গুরুত্ব দিয়ে এর চিকিৎসা হওয়া জরুরি।

সারা বিশ্বে বিশাল জনগোষ্ঠী মানসিক রোগে ভুগছে। নানা কুসংস্কার আর অসচেতনতার কারণে তা গোপন করা হয়। ফলে এই রোগীরা চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। নীরবে দুর্বিষহ জীবন যাপন করছে। মানসিক রোগ মোকাবেলায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সচেতনতা, যা প্রতিরোধ ও প্রতিকার উভয় ক্ষেত্রেই অত্যন্ত জরুরি। বিষণ্নতা, অ্যাংজাইটি, বাইপোলার মুড ডিজঅর্ডার, সিজোফ্রেনিয়া, সাইকোসিস ডিজঅর্ডার, সাবস্টেন্স অ্যাবিউজ, ওসিডি, হেলথ অ্যাংজাইটি, পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার, প্যানিক অ্যাটাক, ফোবিয়া, কনভারশন ডিজঅর্ডার, পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার ইত্যাদিতে মানুষ প্রতিনিয়ত ভুগছে। শিশু, বৃদ্ধ, নারী ও পুরুষ যেকোনো বয়সের মানুষই মানসিক রোগে আক্রান্ত হতে পারে। এক একটা মানসিক রোগের ধরন ও লক্ষণ এক এক রকম। তবে এর সবই ব্যক্তিগত, সামাজিক ও পেশাগত জীবনে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

প্রত্যেক মানুষের সামান্য সচেতনতা ও সহযোগিতা মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতার ক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রাখতে পারে। এ বিষয়ে কিছু করণীয় নিম্নে উপস্থাপন করা হলো:

  • মানসিক রোগ সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব ও কুসংস্কার দূর করার জন্য এ সংশ্লেষে সর্বত্র সহজ ও সাবলীল ভাষায় আলোচনা করা, নিজের ও অপরের (অনুমতি সাপেক্ষে) অভিজ্ঞতা শেয়ার করা;
  • মানসিক রোগকে রোগ হিসেবে গুরুত্ব দেয়া ও অন্যান্য শারীরিক রোগের মতো চিকিৎসার ব্যবস্থা করা;
  • মানসিক রোগ সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব ও কুসংস্কার দূর করা;
  • টেলিভিশনে এ বিষয়ে বিভিন্ন কর্মসূচি ও আলোচনা করা;
  • মানসিক স্বাস্থ্যের পরীক্ষা–নিরীক্ষার সুযোগ বৃদ্ধিকরণ;
  • মানসিক রোগীর পরিবর্তে রোগের বিষয় নিয়ে (অর্থাৎ রোগের লক্ষণ ও চিকিৎসা নিয়ে) আলোচনা করা;
  • স্বাভাবিক জীবনযাত্রার বাইরে অস্বাভাবিক যেকোনো লক্ষণ বা আচরণ দেখা দিলে নির্ভরযোগ্য কারও পরামর্শ নেয়া, এসংশ্লেষে পেশাগত দক্ষতা সম্পন্নের শরণাপন্ন হওয়া;
  • সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এবং গণমাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের মানসিক রোগের লক্ষণ ও চিকিৎসা নিয়ে তথ্য নির্ভর লেখালেখি করা;
  • রোগীকে তার রোগের নাম দিয়ে ‘লেবেলিং’ না করা, অর্থাৎ রোগীকে রোগের নাম ধরে না ডাকা;
  • কমিউনিটি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে শারীরিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক পরামর্শ দেয়া;
  • স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে প্রাথমিক মানসিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা, অন্ততপক্ষে চিকিৎসা সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় তথ্য দেয়া;
  • মানসিক স্বাস্থ্য পেশাজীবীদের কাছ থেকে সঠিক তথ্য জানা ও অন্যদের জানানো;
  • মানসিক রোগকে গালি হিসেবে ব্যবহার না করার জন্য সকলকে সচেতন করা;
  • নিজের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি যত্ন নেয়া ও অন্যকে এ বিষয়ে সহযোগিতা করা;
  • নাটক–সিনেমার মাধ্যমে মানসিক রোগ ও তার চিকিৎসা সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় তথ্য প্রচার করা;
  • শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয়), অফিস বা কর্মস্থলগুলোতে মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক বিভিন্ন কর্মশালার আয়োজন করা ও মানসিক স্বাস্থ্য পেশাজীবী নিয়োগ করা;
  • একাধিক গবেষণার তথ্যমতে, অতিরিক্ত চিনি খাওয়ার সঙ্গে বিষণ্নতার সম্পর্ক রয়েছে। বেশি চিনি খাওয়ার ফলে মস্তিষ্কে কিছু রাসায়নিক ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি হয়, যা মানসিক বিষণ্নতা তৈরি করতে পারে এবং দীর্ঘমেয়াদি মানসিক সমস্যার ঝুঁকিও বাড়ায়। বিধায় মাত্রারিক্ত চিনি গ্রহণ পরিহার আবশ্যক এবং চিনি কম খেয়ে নিজের ওজন ও বিষণ্নতা কমানো যেতে পারে;
  • শরীর সচল থাকলে এন্ডোরফিন নামক একটি হরমোন নিঃসৃত হয়, যা মানসিক চাপ কমিয়ে অবস্থার উন্নতি করে। সূর্যের আলোয় থাকলে মস্তিষ্কে বাড়ে সেরেটোনিনের মাত্রা, যা মানসিক চাপ কমাতে কার্যকরভাবে সাহায্য করে তাই সূর্যের আলোয় সময় কাটানো যেতে পারে;
  • খোলামেলা আবহাওয়ায় মন সতেজ থাকে, তাই গুমোট ঘরে আবদ্ধ না থেকে শরীরে আলো ও বাতাস লাগাতে হবে। এতে মন ও মানসিকতা ভালো থাকবে;
  • গবেষণায় দেখা গেছে প্রতিবছর হতাশা ও উদ্বেগের কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রায় ১ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার পরিমাণ ক্ষতি হয়। কর্মক্ষেত্রের নেতিবাচক পরিবেশ মানসিক স্বাস্থ্যকে প্রভাবিত করে, যা কর্মক্ষেত্রে অনুপস্থিতি বৃদ্ধি ও উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস করে। বিধায় প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে যত্নবান থাকা জরুরি;
  • জার্নাল অব এনভায়রনমেন্টাল সাইকোলজির একটি গবেষণা বলছে, মনস্তাত্ত্বিক চাপ কমাতে ফুল দেখা বা ফুলের কাছে যাওয়া বিশেষ কার্যকর পদক্ষেপ। ফুল দেখলে নেতিবাচক আবেগ, রক্তচাপ ও কর্টিসল নামক হরমোন নিঃসরণ কমে যায়। এ ছাড়া ফুল মানসিক চাপ থেকে মনকে সরিয়ে দেয় অন্যদিকে বিধায় এ পদ্ধতিও অনুসরণ করা যেতে পারে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, মানসিক স্বাস্থ্য বলতে একজন মানুষের ভিতর শুধু কোনো ধরনের মানসিক সমস্যা না থাকাকে বোঝায় না। বরং মানুষ হিসেবে নিজের সক্ষমতাকে অনুধাবন করার সক্ষমতা, আত্মনিয়ন্ত্রণের ভেতর দিয়ে সৃজনশীল ও উৎপাদনশীল কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত থাকা, দৈনন্দিন জীবনের পারিপার্শ্বিক চাপের সঙ্গে ভারসাম্য রেখে চলা এবং সমাজের সামগ্রিক উন্নয়নে অবদান রাখার সক্ষমতাকে মানসিক স্বাস্থ্য বলে।

জিন বা বংশগত ত্রুটি, নেতিবাচক পরিবেশে নেতিবাচক অভিজ্ঞতার ভিতর বেড়ে ওঠা, ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষণ প্রক্রিয়া বা লার্নিং প্রসেস, দুর্বল পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্ক, দরিদ্রতা, নেতিবাচক প্রতিযোগিতার মানসিক চাপ, লোভ, ঘৃণা, মাত্রাতিরিক্ত আমিত্ববোধ, সর্বোপরি জীবন ও জগৎ সম্পর্কে অবাস্তব ও অসত্য দৃষ্টিভঙ্গির চর্চা ইত্যাদি মানসিক স্বাস্থ্য–সমস্যা তৈরিতে সক্রিয় প্রভাবক হিসেবে কাজ করে।

জীবনে চলার পথে সবাই কমবেশি মানসিক জটিলতার ভিতর দিয়ে যায়। কেউ কেউ সেসব জটিলতাকে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং দক্ষতার সঙ্গে মোকাবেলা করতে পারে, আবার কেউ কেউ সেগুলোকে সঠিকভাবে মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হয়। আবার কেউ কেউ মোকাবেলা করতে গিয়ে সচেতন কিংবা অসচেতনভাবে এমন কিছু ত্রুটিপূর্ণ চিন্তা ও আচরণ করে, যা বিদ্যমান জটিলতাকে আরও জটিলতর সমস্যার দিকে ধাবিত করে।

কিছু কিছু সমস্যা আছে যেগুলো সৃষ্টি হওয়ার নেপথ্যে নেতিবাচক পরিবেশ, ত্রুটিপূর্ণ চিন্তা ও আচরণের ধরন, নেতিবাচক লাইফ-স্টাইল মূলত বেশি দায়ী থাকে; যেমন প্রাথমিক বিষণ্ণতা বা ডিপ্রেশন, উদ্বিগ্নতা বা অ্যাংজাইটি, স্ট্রেস ইত্যাদি। আবার অন্যদিকে সিজোফ্রেনিয়া, বাইপোলার মুড ডিজঅর্ডার, অবসেসিভ-কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার বা শুচিবায়ু, অটিজম ইত্যাদির জন্য জেনেটিক্যাল বা বংশগত কারণ বেশি দায়ী।

কোভিড-১৯–এ আক্রান্ত তরুণ বা যুবকদেরও অনেকের শরীরে দীর্ঘ মেয়াদে নেতিবাচক প্রভাব দেখা যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড ভিশনের ‘চিলড্রেন ভয়েসেস ইন দ্য টাইম অব কোভিড-১৯’ শিরোনামে প্রকাশিত এক জরিপে বলা হয়েছে, করোনাকালে ৯১ শতাংশ শিশু–তরুণ মানসিক চাপ ও শঙ্কার মধ্যে রয়েছে। এ সময় শিশু, কিশোর, তরুণদের ঘুমের সমস্যা ও উদ্বেগ অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে।

মানসিক চাপে আছেন বয়স্ক ব্যক্তিরাও। বেশির ভাগই ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদ্‌রোগসহ নানা জটিলতায় ভুগছেন। করোনা সংক্রমণের শুরুর দিকে বলা হয়েছিল, বয়স্ক ব্যক্তিরা বেশি আক্রান্ত হবেন, তখন থেকেই তাঁদের মনে ভয় ঢুকে গিয়েছিল। এরপর যাঁরা করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে মানসিক চাপ বেশি দেখা যাচ্ছে। আর যাঁদের হয়নি, তাঁরাও সংক্রমণের ভয়ে শংকিত থাকেন।

চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে বিশ্ব দ্রুত পরিবর্তনশীল সময়ের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। বিজ্ঞান–প্রযুক্তির দ্রুত বিকাশের মধ্য দিয়ে পরিবর্তনগুলো ঘটছে বস্তুজগতে, সেসব পরিবর্তনের অভিঘাত পড়ছে মনোজগতে এবং দৈনন্দিন জীবনযাপন, ইচ্ছা-অনিচ্ছা ও ব্যক্তিগত সম্পর্ক কাঠামোতেও। ঘরে–বাইরে অস্থিরতা আছে, সহিংসতা আছে, প্রতিযোগিতা আছে। ইন্টারনেটের প্রভাব জীবনের সব ক্ষেত্রে সম্প্রসারিত হচ্ছে। বিশেষত কিশোর ও তরুণদের দিনরাত্রির একটা বড় সময় কাটছে ইন্টারনেটের ভার্চুযয়াল জগতে। সাইবার মাধ্যমে নানা অপরাধও ঘটছে, তারা সেগুলোর শিকার হচ্ছে বা সেগুলোতে অংশ নিচ্ছে।

সাইবার মাধ্যমে উত্ত্যক্ত করা বা সাইবার বুলিং একটি জটিল সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। সহিংস ভিডিও গেম ছড়িয়ে গেছে, এগুলোর নেতিবাচক মানসিক প্রভাব বিশাল মহীরূপ ধারণ করছে। মাদকাসক্তি ও আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সামাজিক মেলামেশা, খেলাধুলার মধ্য দিয়ে যে নিরাপত্তাবোধ নিয়ে সন্তানদের বেড়ে ওঠার কথা, তা যথাযথভাবে হচ্ছে না। আত্মকেন্দ্রিকতা এবং বিচ্ছিন্নতাবোধ দেখা দিচ্ছে না। তরুণদের মানসিক রোগের ঝুঁকি সব সময়ই কমবেশি থাকে। কিন্তু পরিবর্তনশীল বিশ্বের এসব উপাদান এ ঝুঁকিটা বৃদ্ধি করছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, সব ধরনের মানসিক রোগের পঞ্চাশ শতাংশ শুরু হয় চৌদ্দ বছর বয়সের মধ্যে, তিন-চতুর্থাংশ পঁচিশ বছরের মধ্যে। বিশ্বে প্রায় দশ থেকে বিশ শতাংশ শিশু-কিশোর মানসিক রোগে ভুগে থাকে। যথাযথ চিকিৎসা না পেলে তাদের বিকাশ, শিক্ষাগত সাফল্য, জীবনের গুণগত মান বা পরিতৃপ্ত ও পরিপূর্ণতা নিয়ে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা নানাভাবে ব্যাহত হয়। আত্মহত্যা পনের থেকে উনত্রিশ বছর বয়সীদের মধ্যে দ্বিতীয় প্রধান কারণ এবং বিষণ্নতা অন্যতম কারণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরিচালিত জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশে আঠার বছরের শিশু-কিশোরদের প্রায় আঠার শতাংশ মানসিক রোগে ভুগছে। এর মধ্যে শূন্য দশমিক আট শতাংশ মাদকাসক্ত। মস্তিষ্কের দ্রুত বৃদ্ধি, ত্রুটিপূর্ণ জেনেটিক বৈশিষ্ট্য, আর্থসামাজিক পরিবেশ ইত্যাদির জটিল মিথস্ক্রিয়া এর জন্য দায়ী। কৈশোর থেকে প্রাপ্তবয়স্ক সময়কালে যেহেতু মানসিক রোগ হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায় বিধায় এসময়ে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ মানসিক রোগের তীব্রতা হ্রাস করা বা প্রতিরোধে সহায়ক হতে পারে। যেমন-

১. স্কুল, মাদ্রাসা, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়েই কিশোর–তরুণদের প্রতি লক্ষ্য রাখা, তাদের আচরণে মানসিক সমস্যার লক্ষণ প্রকাশ পেলে শিক্ষক ও অভিভাবকদের তা আমলে নেয়া। বিষয়টি অবহেলা না করে মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষার মাধ্যমে সমস্যা শনাক্তকরণ ও চিকিৎসার প্রয়োজন হলে তা নিশ্চিত করা;

২. মানসিক রোগের প্রাথমিক লক্ষণ সম্পর্কে জনসাধারণকে সচেতন করা। এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে সচেতন করতে হবে শিক্ষক, মসজিদের ইমাম, স্বাস্থ্যকর্মী, শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ, স্থানীয় বা পারিবারিক চিকিৎসকদের যাঁদের কাছে অনেক সময় তরুণেরা তাঁদের মানসিক সমস্যার কথা বলেন;

৩. ইতিবাচক অভিভাবকত্ব ও মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে মা–বাবা ও শিক্ষকদের জন্য নিয়মিত ওয়ার্কশপের আয়োজন করা;

৪. স্কুল-কলেজের পাঠ্যসূচিতে ‘মেন্টাল হেলথ’ বিষয়টি আবশ্যিকভাবে অন্তর্ভুক্তকরণ;

৫. অপরাধপ্রবণ এলাকা, বস্তি, শরণার্থী শিবির ইত্যাদি এলাকায় মাদকবিরোধী ও মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কিত কার্যক্রম বৃদ্ধিকরণ;

৬. সামাজিক মেলামেশা, শারীরিক পরিশ্রম হয় এমন খেলাধুলা ও ভালো বন্ধুবান্ধবের সহচার্য বৃদ্ধির উপর গুরুত্বারোপ।

এছাড়াও, শিশুদের লাইফ স্কিল বা জীবনদক্ষতা শেখাতে হবে। জীবনদক্ষতা শুধু স্কুলে ও বাসায় ছোটখাটো নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে শেখায় না, বরং জীবনের বাস্তবতায় প্রবেশের পর ব্যক্তিকে নানা ধরনের অনভিপ্রেত ঘটনা, কষ্ট ও বাধা ভালোভাবে সামলে উঠতে সাহায্য করে এবং জীবনদক্ষতা কিশোর–তরুণদের সার্বিক স্বাস্থ্যের সহায়ক। পাশাপাশি জীবনদক্ষতা শিক্ষা পরিবর্তনশীল বিশ্বে বয়ঃসন্ধিকাল থেকে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত স্বাস্থ্যসেবা তরুণ প্রজন্মের জীবনের নানা সমস্যা ও ঝুঁকি স্বচ্ছন্দে মোকাবিলা করার শক্তি জোগাবে।

 

চিকিৎসাশাস্ত্রের উন্নতির পথ ধরে বৃদ্ধি পাচ্ছে মানুষের আয়ুষ্কাল ফলে সারা বিশ্বেই বাড়ছে প্রবীণদের সংখ্যা। প্রবীণদের মানসিক স্বাস্থ্যগত দিকটিও আলাদাভাবে গুরুত্ব পাচ্ছে। বার্ধক্যেও মানুষ বিষাদগ্রস্ত হতে পারে। কিন্তু নানা কারণে বিষয়টি নজর এড়িয়ে যায়। ফলে ভুক্তভোগীর দুর্ভোগ আরও বেড়ে যায়। যাঁদের বয়স ষাট বা তার ওপরে, তাঁরাই প্রধানত বার্ধক্যজনিত নানা সমস্যার শিকার হন, বিশেষ করে শারীরিক সমস্যা যেমন- উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, বাত-জাতীয় ব্যাথা, স্ট্রোক, ডিমেনসিয়া বা স্মৃতিবৈকল্য ইত্যাদি, এঁদের প্রায় পনের শতাংশ এসব শারীরিক সমস্যার সঙ্গে সঙ্গে ডিপ্রেশন বা বিষণ্নতা রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন।


মধ্য বয়সে অন্যান্য শারীরিক সমস্যার কারণে ডিপ্রেশন বা বিষণ্নতার বিষয়টি তেমন গুরুত্ব পায় না এবং প্রবীণেরাও অনেক সময় এসব উপসর্গের কথা আত্মীয়স্বজনকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেন না। এ কারণে এই রোগের চিকিৎসাও পিছিয়ে যায় বা অবহেলিত হয়। পাশ্চাত্যের বিভিন্ন জরিপে দেখা যায়, বয়স্কদের শতকরা প্রায় পনের জন নানা ধরনের বিষণ্নতায় ভোগেন। আর শতকরা চারজন গুরুতর বা জটিল বিষণ্নতার শিকার হন। বাংলাদেশে বিষণ্নতায় ভোগে মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় চার দশমিক ছয় শতাংশ। বয়োবৃদ্ধদের মধ্যে এই হার প্রায় তিন গুণ।


বয়স্কদের বিষণ্নতার কারণগুলো নানা ধরণের হয়ে থাকে যেমন- সামাজিক, মানসিক ও জৈবিক। সামাজিক কারণগুলোর মধ্যে আছে সামাজিকভাবে নিজেকে গুটিয়ে নেয়া, একাকিত্ব, শোক, দারিদ্র্য, শারীরিক অক্ষমতা ইত্যাদি। মানসিক কারণগুলোর মধ্যে আত্মবিশ্বাসের অভাব, অন্যের সঙ্গে আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে তোলার অক্ষমতা, শারীরিক অসুস্থতা। জৈবিক কারণগুলোর মধ্যে স্নায়ুকোষের ক্ষয় ও স্নায়ুকোষে জৈব রাসায়নিক পদার্থের অভাব, বংশগত ঝুঁকি ইত্যাদি।


বৃদ্ধ বয়সে শারীরিক অসুখ পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে বিষণ্নতার কারণ হতে পারে। নারীদের ক্ষেত্রে রজঃনিবৃত্তি ও ক্যানসার এবং মস্তিষ্কের ক্ষয়জনিত কিছু সমস্যা সরাসরি বিষণ্নতার কারণ হতে পারে। আবার বৃদ্ধ বয়সে বিভিন্ন ধরনের শারীরিক অসুস্থতার জন্য প্রায়ই বিভিন্ন ধরনের ওষুধ খেতে হয়, যা সব সময় সুফল বয়ে আনে না; বরং একসঙ্গে কয়েক ধরন ওষুধ সেবনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায়ও বিষণ্নতা বৃদ্ধি পেতে পারে।

বয়স্কদের চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ঔষুধের সঙ্গে সঙ্গে মনোসামাজিক চিকিৎসা, বিশেষ করে মানসিক সমর্থন, রোগ সম্পর্কে প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যা প্রদান এবং রোগের পরিণতি সম্পর্কে সঠিক তথ্য প্রদান অত্যন্ত ফলদায়ক। কগনিটিভ থেরাপি ও কগনিটিভ বিহেভিয়ার থেরাপি বিষণ্নতা রোগের চিকিৎসার জন্য অত্যন্ত কার্যকরী মনোরোগ চিকিৎসা। কেননা দুর্ভাগ্যজনক হলেও বার্ধক্যে মানুষকে অনেক কিছু হারাতে হয়। যেমন- স্বামী স্ত্রীকে হারান, স্ত্রী স্বামীকে। সব বয়সী আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবের মৃত্যুসংবাদ কানে আসে। সন্তানেরা দূরে চলে যায়। শূন্য গৃহে একাকিত্ব যেন আরও নিষ্ঠুরভাবে গ্রাস করতে থাকে। এসবের পরও যা সবচেয়ে বেশি কষ্ট দেয় বা বিষাদগ্রস্ত করে তোলে তা হচ্ছে সংসারে ক্রমেই মূল্যহীন হয়ে পড়া, সংসারে নিজের দায়িত্ব-কর্তব্য থেকে সরে গিয়ে অন্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়া ইত্যাদি বিষয়। তাই বার্ধক্যে বিষাদ ঠেকিয়ে রাখতে প্রয়োজন প্রবীণদের আত্মমর্যাদার সঙ্গে বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা।

মানসিক রোগে কোনো জীবাণু খুঁজে পাওয়া যায় না। আর্থিক, পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, মহামারি নানা কারণে অসমতার শিকার হলে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সংকট দেখা দিতে পারে। তবে সেটা প্রকট হলে মানসিক রোগ হতে পারে। আমাদের সমাজে ধর্ম, বর্ণ, আর্থিক অবস্থা, শারীরিক অবস্থা—এসব নানা কিছু নিয়ে অসমতা ও বৈষম্য রয়েছে। দিন শেষে এগুলো আমাদের মানসিকভাবে আক্রান্ত করে, বিপর্যস্ত করে। মানসিক সমস্যা আর রোগ কিন্তু এক নয়। মানসিক স্বাস্থ্য যখন খারাপ হয়, তখন মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। সময়মতো মানসিক সমস্যার চিকিৎসা বা নিরাময় না হলে তা একসময় প্রকট আকার ধারণ করে রোগে পরিণত হয়। তাই এ বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি খুবই জরুরি তবে আশার কথা দিন দিনই মানুষের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে সচেতনতা বাড়ছে। একে আরও ত্বরান্বিত করার স্বার্থে মানসিক স্বাস্থ্যসেবাকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে সরকারের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে আসতে হবে। সর্বপরি একটা বিষয় মনে রাখা জরুরি যে, মানসিক সুস্বাস্থ্য বাস্তবিকই বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ যা মোটেও উপেক্ষা করার মত নয়। কারণ, ২০৩০ সালের মধ্যে সকল দেশ সার্বজনীন স্বাস্থ্য কভারেজ (ইউএইচসি) অর্জনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। টেকসই উন্নয়ন এজেন্ডার অংশ হিসেবে সকল দেশ ২০৩০ সালের মধ্যে ইউএইচসি অর্জন করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। মানসিক স্বাস্থ্য ছাড়া কোনও স্বাস্থ্য হতে পারে না এবং স্বাস্থ্য ব্যতীত টেকসই উন্নয়ন হতে পারে না।

গ্রন্থপঞ্জি:

https://barta24.com/details/national/
https://bengali.boldsky.com/health/
https://m.dailyinqilab.com/article/
https://novorup.com/
https://www.daily-bangladesh.com/feature/
https://www.ekushey-tv.com/special-day/news/
https://www.prothomalo.com/lifestyle/health/
https://www.risingbd.com/health/news/