বৈশ্বিক সংকটে টেকসই উন্নয়ন তথা শুদ্ধাচার নিশ্চিতকল্পে খাবারের অপচয়রোধ এবং কৃচ্ছতা সাধন

বৈশ্বিক সংকটে টেকসই উন্নয়ন তথা শুদ্ধাচার নিশ্চিতকল্পে খাবারের অপচয়রোধ এবং কৃচ্ছতা সাধন

©মোঃ আবদুর রহমান মিঞা (‘শেখ হাসিনা ইয়ুথ ভলান্টিয়ার অ্যাওয়ার্ড ২০২০’ পদকপ্রাপ্ত ও মেন্টাল হেলথ অ্যাম্বাসেডর)

শিক্ষা গবেষণা, Human Rights & Social Justice (HRSJ), Victimology & Restorative Justice (VRJ), Human Rights & Social Work (HRSW) ও Clinical Social Work (CSW) বিষয়ের একনিষ্ঠ শিক্ষার্থী

ঠিক যে মূহুর্তে আমরা ভদ্রতার নামে কিছু খাবার প্লেটে ফেলে রাখি বা অতিথি নারায়ণে স্বাভাবিক মাছের টুকরা ভিআইপি টুকরায় পরিণত করার জন্য মোটা মোটা পিস করে কাটি বা তথাকথিত অতিথি নারায়ণকে খুশি করা তথা নিজের স্ট্যাটাস বা স্বচ্ছলতা বা ভোজন রসিকতা বোঝানোর স্বার্থে খাবারের হরেকরকম পদ তৈরি করে টেবিলে পরিবেশন করি। যা হয়ত একজন সাধারণ মানুষের পক্ষে খাওয়া সম্ভব না কিংবা বাড়তি খাবার কাউকে না দিয়ে সংরক্ষণ করি এবং পরবর্তীতে যেখানে সেখানে খাবার ফেলে দেই। আমাদের অনেকেরই বাড়ীর খাবার ভালো লাগে না বা স্বাদ পাই না বা মজা লাগে না এমন নানা অজুহাতে কত খাবার নষ্ট করি তার ইয়ত্তা নাই। কখনও এ রেস্টুরেন্ট তো কখনও ঐ রেস্টুরেন্টে ঢুঁ মারি। আবার পছন্দসই না হলে অর্ধেক খাবার ফেলে রেখেই চলে আসি। ঠিক সে মূহুর্তে মাটি আর আবর্জনা দিয়ে হাইতিয়ান নারীরা এক ধরনের বিস্কিট তৈরি করেন, যা খেয়েই উদরপূর্তি করে হাইতির শিশুসহ সকল জনগণ। এ খাবার খেতে পেয়েই তারা ভীষণ খুশি। খাবারের সময় বাচ্চারা অনেক সময় পুরো বিস্কিট টা হয়ত খেতে পারে না তখন তাদের মায়েরা সন্তানদের বলে থাকেন-

‘মানুষ খাবার পায় না, আর তোরা খাবার নষ্ট করিস’!

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার বর্ণনা মতে, প্রতি বছর আনুমানিক এক দশমিক তিন বিলিয়ন টন খাবারযোগ্য খাদ্য নষ্ট হয়, যার মূল্য সাতশত পঞ্চাশ মিলিয়ন ইউএস ডলারের সমতুল্য! অথচ একই গ্রহ, পৃথিবীতেই এমন কিছু দেশ আছে, যেখানে সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ না খেতে পেয়ে ক্ষুধা নিবারনের জন্য নিয়মিত মাটির বিস্কুট বানিয়ে খাচ্ছে। জীবন ধারণের জন্য সবচেয়ে বড় উপাদান হচ্ছে খাবার। কিন্তু খাবার অপচয়ের হার যেনো দিন দিন বেড়েই চলেছে। আমাদের সবচেয়ে নিরর্থক সমস্যাগুলোর মধ্যে প্রধান হল খাদ্য অপচয়। পৃথিবীতে উৎপাদিত সকল খাদ্যের তিন ভাগের এক ভাগ সরাসরি আবর্জনায় পরিণত হয়। অন্যদিকে প্রতি বছর প্রায় এক কোটি লোক খাবারের অভাবে মৃত্যুবরণ করেন। খাদ্য অপচয় বলতে শুধু অর্ধেক খেয়ে ফেলে দেয়া না, এমন বহু খাদ্য অপচয় করা হয় যা কখনো কারো প্লেটেও ওঠে নাই। এমনকি সেসব খাবার পুনরায় বিক্রি করার উপযোগী। কিন্তু সে খাবার কোনো গরিবকে না দিয়ে ডাস্টবিনে ফেলে দেয়া হয়।

একথা অধিকাংশ মানুষই মানতে নারাজ যে, ‘জীবনের জন্য খাবার, খাবারের জন্য জীবন নয়’। বেশীরভাগ মানুষই অহেতুক উছিলা খোঁজে খাবার বা উদরপূর্তির যেমন কেউ ভাল রেজাল্ট করছে ‘চল খাই’, বিয়ে করছে ‘চল খাই’, সভা সমাবেশ হবে ‘চল খাই’, ওয়ার্কশপ-সেমিনার হবে ‘চল খাই’, কেউ মৃত্যুবরণ করেছে ‘চল খাই’, কোন শিশুর মুসলমানী ‘চল খাই’ ইত্যাদি ইত্যাদি। শুধু খেলে হবে না, চাই মজার মজার ডিশ বা স্ন্যাক্স বা আইটেম। এছাড়াও অতিথি নারায়ণের জন্য পোলাও বিরিয়ানি রান্নার পাশাপাশি আয়োজন করা হয় সাদা ভাতের, যদি অতিথি নারায়ণের রিচ ফুডে সমস্যা হয় তাহলে যেন চারটা ডাল-ভাত খেতে পারেন! খাবারশেষে লাগবে ডেজার্ট হিসাবে দই (এখানে আবার মিষ্টি দই, টক-মিষ্টি দই এবং টক দই অতিথির শরীরের সুগার লেভেলের উপর নির্ভর করে যেন সঠিক খাবারটি নিতে পারেন), মিষ্টি (বেশী মিষ্টি ও হাল্কা মিষ্টিওয়ালা), ডিমের পুডিং (মিষ্টি ও মিষ্টি ছাড়া), ড্রিংকস (ডায়েট এবং নন-ডায়েট হতে হবে কারণ ঐ শরীরের সুগার লেভেল! স্বাস্থ্য সচেতনতা বলে কথা), পায়েশ (মিষ্টি এবং মিষ্টি ছাড়া) ইত্যাদি ইত্যাদি। কৃচ্ছতা সাধন দুরে থাকুক শরীরের ক্ষতির বিষয়টিও বিবেচনায় আসে না। এ যেন এক বিচিত্র সেলুকাস, খাবারের মচ্ছব।

অন্যদিকে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি)-এর হিসাব অনুযায়ী, গোটা বিশ্বে প্রতি রাতে আটশত এগার মিলিয়ন মানুষ ক্ষুধা পেটে ঘুমাতে যায়। খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও)-এর মতে, প্রতি বছর যে পরিমাণ খাবার নষ্ট হয় বা আবর্জনায় ফেলে দেয়া হয়, তার এক-তৃতীয়াংশ দিয়ে বিশ্বের আটশত সাতাত্তর মিলিয়ন ক্ষুধার্ত মানুষকে খাওয়ানো যেতে পারে। জাতি সংঘের তথ্য মতে, বিশ্বব্যপী প্রায় পঁচাশি কোটিরও বেশি লোক তীব্র অপুষ্টিতে ভুগছে। শুধু তা-ই নয়, প্রতিবছর নতুন করে দশ কোটি লোক খাদ্য কেনার সামর্থ্য হারায়।

অ্যাকশন এইড-এর এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে বিয়ের অনুষ্ঠানে সবচেয়ে বেশি খাবার নষ্ট হয়। এর পরেই খাবার নষ্ট হয় রেস্তোরাঁয়। এছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানেও প্রচুর খাবার নষ্ট হয়। বুফে রেস্টুরেন্টও খাবার নষ্ট হয়। একটি বুফে তাদের দৈনিক খাদ্যের বর্জ্য পরিমাপ করেছে উনত্রিশ কেজি, যা সহজেই পঁচাশি থেকে নব্বই জন ক্ষুধার্ত মানুষকে খাওয়াতে পারত। কখনও কখনও এর পরিমাণ বেশি হয়। যদি একটি বুফে রেস্টুরেন্টই উনত্রিশ কেজি খাবার অপচয় করে, তাহলে দেশব্যাপী হাজার হাজার হোটেল ও রেস্টুরেন্টে প্রতিদিন কত খাবার অপচয় হয়, তার হিসাব কি আমরা করি? এর বাইরেও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, পিকনিক, শিক্ষাসফর (যা মূলত পিকনিকই বানিয়ে ফেলা হয়েছে), বনভোজন ইত্যাদির নামেও খাবার অপচয় করা হচ্ছে। শহরে রাস্তার পাশের ডাস্টবিনে প্রতিদিন প্রচুর খাবার জমতে দেখা যায়। এগুলো আবর্জনার মতো দেখায়; কিন্তু আসলে এগুলো অনেক লোকের জীবন রক্ষাকারী উপাদান। এভাবে প্রতিদিনই বিভিন্নভাবে প্রচুর খাবার আমরা নষ্ট বা অপচয় করি।

শহরাঞ্চলের পাশাপাশি গ্রামীণ জনপদেও গায়েহলুদ, বিয়ে, জন্মদিন, আকিকা, আকদ, কুলখানি ইত্যাদি অনুষ্ঠানে খাবার অপচয়ের দিক থেকে পিছিয়ে নাই। এখন গ্রামের মানুষও তথাকথিত আধুনিকতাকে ধারণ করার পেছনে ছুটছে, আগের মতো আর খাবারের প্লেট চেটেপুটে খায় না। এসব দৃশ্য সমাজের মানুষের কাছে ক্রমেই স্বাভাবিক হয়ে উঠছে। অপচয়কে এখন আর অপচয় মনে হয় না, এ যেন বিলাসিতা। একদিকে খাবার অপচয়ের উৎসব হয়, আর অন্যদিকে গরিব প্রতিবেশীরা অভূক্ত থাকে। মানবতার কী নির্মম পরিহাস!

যেটা আমাদের কাছে স্মার্টনেস মনে হচ্ছে, সেটা হয়তো আগামী দিনের পৃথিবীকে ক্ষুধার সাগরে ডুবিয়ে দিতে যথেষ্ট। টাকা থাকলেই যে খাবার পাওয়া যাবে, তা কিন্তু নয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের হোটেলগুলোতে কাস্টমার চাইলেই পর্যাপ্ত খাবার সরবরাহ করা হয় না, হোটেল কর্তৃপক্ষ পর্যবেক্ষণ করে দেখে যে খাবারের অর্ডার দেয়া হচ্ছে তা কি কাস্টমার খেতে পারবে না ফেলে দিবে? এরপরও পরিমিত খাবার সরবরাহ করার পরে যদি কাস্টমার সব খাবার না খেয়ে প্লেটে ফেলে দিয়ে চলে যাওয়ার চেষ্টা করে তবে স্থানীয় পুলিশ ডাকা হয় কেন খাবার নষ্ট হল তার বিচারের জন্য।

অপচয়ের কারণে অধিক খাদ্য উৎপাদনের জন্য বনভূমি প্রতিনিয়ত কৃষিজমিতে রূপান্তরিত হচ্ছে। ফলে পরিবেশ ও জলবায়ুর ভারসাম্য রক্ষার কাজ কঠিন হয়ে পড়ছে। কীটনাশক ও রাসায়নিক সার ব্যবহারের কারণে নদীনালা, খালবিল ও ফসলের ক্ষেত বিষাক্ত হয়ে পড়ছে। নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ ও পশুপাখি। অতিরিক্ত খাদ্য উৎপাদনে অতিরিক্ত জ্বালানির ব্যবহার গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ বাড়াচ্ছে। প্রতি বছর তিনশত ত্রিশ মিলিয়ন টন কার্বন ডাই অক্সাইড বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে। অপচয়ের ফলে অতিরিক্ত খাদ্য উৎপাদনের নেতিবাচক প্রভাব শুধু পরিবেশ ধ্বংসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই; বরং আমরা যত বেশি খাদ্য অপচয় করছি, বিশ্বব্যাপী খাদ্যের মূল্য বৃদ্ধিতে তত বেশি ভূমিকা রাখছি। ফলশ্রুতিতে টেকসই উন্নয়নের সতেরটি লক্ষ্যমাত্রাই অর্জন বাঁধাগ্রস্থ হচ্ছে, বিশ্ব পিছিয়ে পড়ছে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে।

খাদ্য অপচয় রোধে যা করা যেতে পারে-

কেনাকাটায় স্মার্টনেস

চাহিদার তুলনায় বেশি কেনাকাটা না করা। কেনাকাটার ক্ষেত্রে পূর্বেই একটা তালিকা তৈরি করা এবং যা যা প্রয়োজন শুধু সেগুলোই কেনা। পরেরবার বাজারে যাওয়ার পূর্বে আগের বার কেনা সব জিনিস ব্যবহার করা হয়েছে কিনা তা নিশ্চিত হওয়া। অনেকেই প্রয়োজনের চেয়ে বেশি খাদ্য সামগ্রী কিনে থাকেন। একসঙ্গে অনেকগুলি খাবার কেনার ফলে সাশ্রয় হয় ঠিকই। কিন্তু সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে এ পদ্ধতিতে কেনাকাটা করলে খাদ্য অপচয় হয় বেশি। এ প্রবণতা হ্রাসকরণের জন্য সপ্তাহে একবার বাজারে গিয়ে বেশি খাবার কেনার পরিবর্তে দুই-তিন দিন অন্তর খাবার কেনার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। প্রয়োজনীয় খাদ্য সামগ্রীর একটি তালিকা তৈরি করে নিতে হবে এবং কোনাকাটার সময় তালিকার বিচ্যুতি কোনভাবেই ঘটতে দেয়া যাবে না। বাজারে গেলে অনেক সময়ই বিভিন্ন সরঞ্জাম দেখে মানব মন বিচলিত হয় এবং প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি খাদ্যদ্রব্য ক্রয় করে ফেলে। ফলশ্রুতিতে শুধুমাত্র যে খাদ্যদ্রব্য অপচয় হওয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায় তা-ই নয় বরং অর্থেরও অপচয় ঘটায়। তাই বাজারে যাওয়ার আগে প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যের একটি তালিকা প্রণয়ন ও সে অনুযায়ী খাদ্যদ্রব্য ক্রয় করতে হবে। খালি পেটে বাজার করতে যাওয়া যাবে না, কেননা এ অবস্থায় বাজারে গেলে সব কিছুই খেতে ইচ্ছা করবে এবং কেনার পরে তা নষ্ট হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে।

সকল ক্ষেত্রে পারফেকশানিস্ট হওয়ার প্রচেষ্টা পরিহার

সবচেয়ে সুন্দর ও ফ্রেশ দেখায় এমন ফল-সবজি কেনার হিড়িক পড়ে যায় যা মূলত খাবার অপচয়ের পথকে প্রশস্ত করে। অনেকেই নিঁখুত ও সবচেয়ে ভালো দেখতে ফল ও সবজি কিনতে চান। এর ফলে সাধারণ বা গ্রহণযোগ্য খুঁতবিশিষ্ট, ত্যারাবাঁকা আকৃতির ফল-সবজিটি বাতিলের তালিকায় স্থান পায়, অবশেষে পচে গেলে ফেলে দিতে হয় এগুলোকে। অপচয় রোধ করার জন্য সামান্য খুঁত বিশিষ্ট ফল-সবজি মূল্যহ্রাসে বিক্রি করার প্রবণতা দেখা যায়। তাই বাজার করার সময় এ বিষয়টিও বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন।

যথাযথ পদ্ধতিতে খাবার সংরক্ষণ

আজকালকার দিনে বেশিরভাগ খাদ্যদ্রব্যই আমরা ফ্রিজে রাখি, যাতে জিনিসগুলো ভালো থাকে। তাই ফ্রিজের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত জরুরি। খাদ্যদ্রব্যকে ফ্রেশ রাখার জন্য °১ থেকে °৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস হল আদর্শ তাপমাত্রা। ফ্রিজের তাপমাত্রা বেশি বেড়ে গেলে অনেক সময়ই খাদ্য নষ্ট হয়ে যেতে পারে।

খাবার যথাযথভাবে সংরক্ষণ না করলে অনেক বেশি খাবার অপচয় হয়। অনেকেই জানেন না যে সবজি এবং ফলমূল কিভাবে সংরক্ষণ করতে হয়। এজন্য অনেক সময় ভালোভাবে পাকার আগে কিংবা বেশি পেকে গেলে তারপর সেগুলো সংগ্রহ করা হয়। আলু, টমেটো, রসুন, শশা এবং পেঁয়াজ কখনোই ফ্রিজে রাখা উচিত নয়। এগুলো ঘরের তাপমাত্রায় রাখা উচিত। পাতাযুক্ত কাণ্ড বা শাক এবং লতানো খাবার পানি দিয়ে রাখতে হবে। রুটি ফ্রিজে রাখা যেতে পারে যদি মনে হয় যে সেগুলো একবারে খেয়ে শেষ করা সম্ভব নয়। সম্ভব হলে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে কেনাকাটা করার চেষ্টা করুন। এছাড়া এটি আপনার সময় এবং অর্থ-দুটিই বাঁচাবে। ফ্রোজেন খাবার সবসময় অপচয় রোধ করে এবং এগুলো স্বাস্থ্য সম্মতও বটে। যেমন, সালাদ হিসেবে যেসব সবুজ সবজি খাওয়া হয় সেগুলো সহজেই ফ্রিজে রাখা যায়। ব্যাগ কিংবা কন্টেইনারে করে এসব সবজি রেখে দিন এবং পরে সেগুলো স্মুদি বা অন্য রেসিপির জন্য ব্যবহার করুন। শাক বা লতানো খাবার অলিভ অয়েল আর টুকরো রসুনে মিশিয়ে বরফ তৈরির ট্রেতে করে সংরক্ষণ করা যায়। যা পরে ভেঁজে খাওয়া যায় বা অন্যান্য খাবার তৈরিতে ব্যবহার করা যায়। অতিরিক্ত খাবার যেমন ফার্মে বেশি পরিমাণে উৎপাদিত কোন খাদ্য পণ্য, স্যুপ বা মরিচের মতো পরিমাণে বেশি হয় এমন খাবারও ফ্রিজে সংরক্ষণ করা যায়। এর মাধ্যমে সব সময় স্বাস্থ্যকর এবং ঘরে রান্না করা খাবারের চাহিদা পূরণও সম্ভব হয়।

ভুল পদ্ধতিতে স্টোর করে রাখার ফলেও প্রচুর পরিমাণে খাবার নষ্ট হয়ে যায়। ন্যাচরাল রিসোর্স ডিফেন্স কাউন্সিলের মতে, ইউনাইটেড কিংডমের দুই তৃতীয়াংশ পরিবার পচে যাওয়া খাবার ফেলে দেয়। অনেকেই ফল ও সবজি স্টোর করার সঠিক পদ্ধতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন। যার ফলে অনেক ফল-সবজিই সময়ের আগে পেকে গিয়ে পচতে শুরু করে। ইথাইলিনের কারণে খাবার তাড়াতাড়ি পেকে গিয়ে পচতে শুরু করে। কলা, আভাকাডো, টমেটো, ক্যান্টালোপ, পিচ, নাশপাতি, পেঁয়াজকলি ইথাইলিন গ্যাস উৎপন্ন করে পাকতে শুরু করে। তাই আলু, আপেল, শাকপাতা, বেরি ও নানান রঙের শিমলা লঙ্কার মতো ইথাইলিন সেনসিটিভ ফল-সবজি থেকে উপরোক্ত খাদ্য দ্রব্য দূরে রাখুন।

বেঁচে যাওয়া খাবার ফ্রিজে রেখে দিয়েই ভুলে যান অনেকে। ফলে সেগুলিও এক সময় নষ্ট হয়ে যায়। স্টিলের কন্টেনারের পরিবর্তে গ্লাস কন্টেনারে বেঁচে যাওয়া খাবার রাখলে সেগুলি চোখের সামনে থাকবে এবং তা আগে শেষ করার কথাও মনে থাকবে। এর ফলে খাবার অপচয় তো হবেই না, বরং আপনার সময় ও অর্থও বাঁচবে।

ফ্রিজ ক্লাটার ফ্রি রাখা

‘আউট অফ সাইট, আউট অফ মাইন্ড’ বাক্যটি খাবার-দাবারের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। খাবার-দাবারে পরিপূর্ণ ফ্রিজ দেখতে মানসিক শান্তি লাগলেও ফ্রিজে গাদাগাদি করে খাদ্য দ্রব্য রাখার প্রবণতা ত্যাগ করা জরুরি। কারণ এর ফলে অপচয়ের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। ফ্রিজে যথাযথভাবে খাবার দাবার সাজিয়ে রাখতে হবে, এমন ভাবে রাখতে হবে যেন সব খাবারই চোখের সামনে থাকে। এক্ষেত্রে FIFO (ফার্স্ট ইন ফার্স্ট আউট) পদ্ধতি বেশী কার্যকর। বাড়িতে আগে থেকে ফল বা কোনও সবজি থাকা সত্ত্বেও, সেই একই ফল বা সবজিই যদি ভুলে পুনরায় কেনা হয় তবে নতুন বক্সটিকে পুরনো বক্সের পিছনে রাখতে হবে। এর ফলে পুরনো দ্রব্যাদি আগে ব্যবহার করার কথা মনে থাকবে এবং অপচয় কমবে। মুদি দোকানের কেনাকাটা শেষে তা ঠিকভাবে সাজিয়ে রাখতে হবে। গ্রোসারি আইটেম হোক কিংবা অন্যান্য খাদ্যদ্রব্য, সর্বদাই পুরোনো খাবারগুলি আগে শেষ করে তারপর নতুন খাবারে হাত দিতে হবে। ফলশ্রুতিতে খাদ্যদ্রব্যের মেয়াদ শেষ হওয়ার সম্ভাবনা অনেকটাই কমবে, খাবার নষ্টও হবে না এবং খাদ্যের অপচয়ও হ্রাস পাবে। একইভাবে সদ্য কিনে আনা মুদি দোকানের জিনিসগুলি স্টোর করার সময়, পুরোনো মুদির জিনিসগুলি সামনের দিকে এবং নতুন জিনিসগুলি পিছনের দিকে রাখতে হবে।


সংরক্ষণে ফ্রিজের বাইরে ভাবনা

খাদ্য সংরক্ষণের ক্ষেত্রে ফার্মেন্টিং বা পিকলিং নতুন পন্থা মনে হলেও, বিষয়টি নতুন না, সেই প্রাচীন কাল থেকেই এ উপায়ে খাদ্য সংরক্ষণ করা হয়ে আসছে। ২৪০০ খ্রীষ্টপূর্ব থেকেই ভিনিগার বা ব্রাইন মিশিয়ে খাদ্য সংরক্ষণের প্রক্রিয়া প্রচলিত ছিল। আচার বানিয়ে, খাবার শুকিয়ে, ক্যানিং, ফার্মেন্টিং, ফ্রিজিং এবং কিউরিং এ সমস্ত পদ্ধতিতে খাবার দীর্ঘদিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়। যা শুধু খাবারের অপচয়ই কমাবে না বরং অর্থেরও সাশ্রয় ঘটাবে। এ পদ্ধতিগুলোর মধ্যে অধিকাংশ সংরক্ষণ প্রক্রিয়া সহজ, সাধারণ এবং মজার। যেমন ক্যানিংয়ের মাধ্যমে পাকা আপেল দিয়ে অ্যাপেল সস বানিয়ে ফেলা যায়। আবার গাজরকে ভিনিগারে মিশিয়ে দীর্ঘ দিনের ব্যবহারের জন্য রেখে দেয়া যায়। ফল এবং শাকসবজি বেশিদিন ফেলে রাখলে পচে যায়, তাই ঘরে ফেলে না রেখে সেগুলি ব্যবহার করতে হবে। বাড়িতে থাকা ফলগুলি নরম হয়ে গেলে, সেগুলি স্মুদি বা শেক বানিয়ে খাওয়া যেতে পারে। এছাড়াও, রুপচর্চার কাজেও ব্যবহার করা যেতে পারে। আর সবজি যদি তার সতেজ ভাব হারাতে থাকে, তাহলে সেগুলি স্যুপ বানিয়ে খাওয়া যায়। অত্যধিক পেকে যাওয়া আভাকাডোর সঙ্গে মধু মিশিয়ে ফেসপ্যাক বানানো যায়। আবার কফির গুঁড়ার মধ্যে চিনি ও অলিভ অয়েল মিশিয়ে এটিকে বডি স্ক্রাব হিসেবে ব্যবহার করা যায়। এ ছাড়াও আনারসের খোসা দিয়েও তৈরি করা যায় স্ক্রাব। ব্যবহৃত টি ব্যাগ ফেলে না-দিয়ে তা ঠান্ডা করে এর সাহায্যে চোখের নীচের কালো দাগ দূর করার চেষ্টা করা যেতে পারে। শশা শুকোতে শুরু করলে, তা গোল গোল করে কেটে তা চোখের ওপর রেখে চোখ ঠান্ডা রাখতে বা রূপচর্চায় ব্যবহার করা যায়।

চাকরিজীবীদের দুপুরের খাবার বাসা থেকে নেয়ার অভ্যাসকরণ

রাতের বা সকালের বেচে যাওয়া খাবার প্যাকেট করা লাঞ্চ হিসেবে খাওয়া যেতে পারে। যা অপচয় হ্রাসে সহায়ক। যদিও সহকর্মীদের সাথে খাবার খেতে বাইরে যাওয়া কিংবা পছন্দের কোন রেস্টুরেন্টে গিয়ে পছন্দের খাবারটি খাওয়া বেশ আনন্দদায়ক, কিন্তু এগুলো বেশ দামি এবং এতে খাবার অপচয়ের সম্ভাবনাও বেশি থাকে। অফিসের মধ্যাহ্নভোজ হিসেবে সাথে করে নিয়ে যাওয়া খাবার অর্থ সাশ্রয় এবং সেই সাথে কার্বন নিঃসরণ কমাতে সহায়তা করে। সকালে যদি হাতে সময় কম থাকে, তাহলে আগেই উদ্বৃত্ত খাবার ছোট-ছোট কন্টেইনারে করে ফ্রিজে রেখে সংরক্ষণ করুন। এভাবে, আগে রান্না করা এবং মুখরোচক খাবার মধ্যাহ্নভোজ হিসেবে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রতিদিন সকালে আপনার হাতের কাছেই থাকবে।

কুসুমসহ ডিম খাওয়া

কম কোলেস্টেরল যুক্ত খাবার খাওয়ার জন্য অনেকেই ডিমের কুসুম ফেলে দেন। কিন্তু বিভিন্ন গবেষণা ও সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, কোলেস্টেরল স্তরের ওপর ডায়েটারি কোলেস্টেরলের প্রভাব থাকে খুবই কম। যকৃত বা লিভারই প্রয়োজনীয় কোলেস্টেরল উৎপন্ন করে থাকে। অধিক কোলেস্টেরল সম্পন্ন খাবার খাওয়ার ফলে কম পরিমাণে কোলেস্টেরল উৎপন্ন করে ভারসাম্য বজায় রাখে লিভার। সর্বোপরি কুসুম নানান পুষ্টিকর উপাদানে সমৃদ্ধ। সমীক্ষায় প্রমাণিত, কারও উচ্চ কোলেস্টেরল থাকলেও তাঁরা নির্দ্বিধায় কুসুম খেতে পারেন। তবে সরাসরি কুসুম খেতে না-চাইলে, সেটিকে অন্য কোনও খাবারের সঙ্গে মিশিয়ে নেয়া যেতে পারে।

সবজি ও ফলের খোসা খাওয়া

সবজি ও ফলের খোসা ছাড়িয়ে সাধারণত রান্না করা হয়ে থাকে। অথচ খোসাতেই সর্বাধিক পরিমাণে পুষ্টিকর উপাদান থাকে। আপেলের খোসা, মুরগির মাংসের স্কিন এ সবই একাধিক পুষ্টিকর উপাদানে সমৃদ্ধ। শুধু তাই নয় আলু, গাজর, শশা, আম কিউই, বেগুনের খোসাও খাওয়া যেতে পারে। এর ফলেও খাবার অপচয়ের প্রবণতা হ্রাস করা সম্ভব।

বাড়িতে স্টক তৈরি করণ

বাসায় বেচে যাওয়া সবজি দিয়ে স্যুপ রান্না করলে খরচও বেশ কমে আসে। খাদ্য অপচয় কমানোর একটি সহজ উপায় হচ্ছে ঘরেই স্টক তৈরি করা। সবজির বিভিন্ন অংশ যেমন উপরের অংশ, ডাটা, খোসা বা অন্য যে কোন অংশ ছোট টুকরা করে কেটে অলিভ অয়েল বা মাখন দিয়ে মেখে তারপর পানি মিশিয়ে এবং পরে ফুটিয়ে এগুলো দিয়ে মজাদার সবজি ব্রথ বা স্যুপ তৈরি করা যায়, যা মহামূল্যবান খাবার সাশ্রয়ে সহায়ক।

স্মুদি তৈরিপূর্বক তা পান

ছোট পরিবারের ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, এক সঙ্গে অনেকগুলি সবজি রান্নার কারণে ছোট ছোট সবজি বা ফলের টুকরা ফ্রিজে সংরক্ষণ করা হয়ে থাকে। যেগুলি পরবর্তীকালে কোনও কাজে আসে না এবং ফেলে দিতে হয়। তাই কোনও কারণে, গাজর, বিট, কেল, বা অন্য কোনও ফলের টুকরা বা অধিক পাকা কলা বেঁচে গেলে সেটি ফেলে না-দিয়ে স্মুদি বানিয়ে পান করা যেতে পারে।

পানির স্বাদ বৃদ্ধিকরণ

নিয়মিত পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করলে একদিকে যেমন শরীরের ডিহাইড্রেশন দূর হয় অন্যদিকে ক্ষুধা নিবৃত করে। কিন্তু অনেকেই পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করেন না কারণ পানির স্বাদ পছন্দ না হওয়ায়। তাই পানীয় জলকে বিভিন্নভাবে সুস্বাদু করে নেয়া যেতে পারে যেমন- আপেল বা কোনও সাইট্রাস ফল অথবা শশার খোসাকে পানিতে মিশিয়ে কিছুক্ষণ রেখে দিলে সে পানির স্বাদ বৃদ্ধি পায় এবং মুখরোচক হয়।

প্রয়োজনানুযায়ী রান্না ও খাওয়া

একসাথে অনেক রান্না না করে, যতটুকু দরকার ততটুকু রান্না করতে হবে, প্রয়োজনে একটু কম রান্না করা ভাল কেননা খাবার হাড়িতে একটু থেকে গেলে উপযোগ ‍নিবৃত হওয়ার পরেও খাওয়ার অভ্যাস থাকে। এর ফলে খাদ্য অপচয় কম হবে এবং আর্থিক দিক থেকেও সাশ্রয়ী ও লাভবান হওয়া যায়। অনেকেই মাত্রারিক্তি খাবার খেয়ে থাকেন, তা ছাড়া এক সঙ্গে বেশি খাবার নিয়ে তা শেষ করতে গিয়ে ঘাম ছুটে যায় অনেকেরই। অধিকাংশ লোকের আবার প্লেটে খাবার ফেলে রাখার বদভ্যাস থাকে, তাই প্লেটে অল্প অল্প করে খাবার নিয়ে খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। এর ফলে ওভার ইটিংয়ের প্রবণতা কমবে এবং উচ্ছিস্ট খাবারও ফেলা হ্রাস পাবে। যদি কোন কারণে অধিক রান্না করা হয়েও যায় এবং নিয়মিতই খাবার উদ্বৃত্ত থাকে, তাহলে সপ্তাহে একটি দিন ঠিক করতে হবে যেদিন নতুন করে রান্না না করে ফ্রিজে সঞ্চিত থাকা খাবার খেতে হবে। খাবার ফেলে দেয়া রোধে এটি একটি ভালো পন্থা হতে পারে।

বীজ ফেলে না দিয়ে খাওয়া ও রোপণ

অনেকেই বিভিন্ন সবজি বা ফলের খাবারযোগ্য বীজ ফেলে দেন। অথচ সেসব বীজে ম্যাগনেশিয়াম, মিনারেলসহ নানা ধরনের পুষ্টি বর্ধক উপাদান থাকে। যা রক্ত পরিশুদ্ধ, হৃদপিন্ড সবল, উচ্চরক্তচাপ ও রক্তে শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করতে সহায়ক। তাই খাবারযোগ্য বীজসমূহ ফেলে না দিয়ে খেতে হবে। বীজ খাওয়ার পাশাপাশি পরিবেশের টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিতকল্পে রোপণের ব্যবস্থাও করা যেতে পারে।


মেয়াদ বা এক্সপায়রেশন ডেট দেখে কেনাকাটা

‘সেল বাই’, ‘বেস্ট বাই’, ‘ইউজ বাই’ এবং ‘এক্সপায়ার্স অন’ সংশ্লেষে অনেকেই কনফিউজ থাকেন। ‘সেল বাই’ এর মাধ্যমে রিটেলার বা খুচরা বিক্রেদার অবগত করা হয় কত দিনের মধ্যে ঐ সামগ্রী বিক্রি করতে বা শেল্ফ থেকে সরিয়ে নিতে হবে। ‘বেস্ট বাই’ লেখা থাকলে ক্রেতারা সে তারিখের মধ্যেই তা ব্যবহার বা ভোগ করে ফেলবেন। তবে উল্লিখিত তারিখের পর সে দ্রব্য যে ব্যবহার করা যাবে না, এমন কোনও নির্দেশ থাকে না। তবে ‘ইউজ বাই’ বা  ‘এক্সপায়ার্স অন’ লিখে কোনও তারিখ দেয়া থাকলে, সে খাবার বা পণ্য উল্লেখিত তারিখের মধ্যে অবশ্যই শেষ বা ব্যবহার করে ফেলতে হবে। কারণ তারপর এ খাবার বা পণ্য গ্রহণ নিরাপদ না। খাবারের মেয়াদ ফুরিয়ে যাওয়ার কারণে আমরা বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য ফেলে দেই বা নষ্ট করে ফেলি, তাই খাবার যাতে নষ্ট না হয়, সেজন্য গ্রসারি শপিং এর সময় প্রতিটি প্যাকেটের ওপর লেখা এক্সপায়রি ডেট দেখার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। প্রত্যেকটি জিনিসেরই একটি নির্দিষ্ট মেয়াদ দেয়া থাকে। এগুলো লক্ষ্য রাখা এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তা ব্যবহার নিশ্চিত করলে একদিকে যেমন অপচয় কম হবে এবং অন্যদিকে আর্থিক সাশ্রয় হবে।

সার তৈরিকরণ

সব নিয়ম বা পদ্ধতি অনুসরণ করার পরেও যদি কোন খাবার উদ্বৃত্ত হয়ে যায় বা নষ্ট হয়ে যায় তবে সে খাবার দিয়ে বাড়িতেই তৈরি করা যায় জৈব সার। উদ্বৃত্ত খাবার পুনরায় ব্যবহার করার একটি অন্যতম উপায় হচ্ছে এগুলো দিয়ে সার তৈরি করা, যা গাছের জন্য শক্তির যোগান দেয়। সবার যেহেতু বাড়ির বাইরে সার তৈরির ব্যবস্থা নাই, তাই রান্নাঘর বা ছোট্ট পরিসরে সার তৈরির এ ধরণের ব্যবস্থা বা কাউন্টার টপ কম্পোস্টার ব্যবহার করা যেতে পারে। যাদের বড় বাগান রয়েছে তারা চাইলে বাইরেই একটি কম্পোস্টার ব্যবহার করতে পারেন। আর কাউন্টার টপ কম্পোস্টার শহরের বাসিন্দা বিশেষ করে যাদের ছোট বাগান বা গাছ রয়েছে তাদের জন্য উপযোগী। বেঁচে যাওয়া খাবার দাবার বা ফল-সবজির খোসা কম্পোস্ট করে তা সার হিসেবে কাজে লাগাতে পারে। বাগান বা কিচেন গার্ডেন থাকলে খাবার কম্পোস্ট করে নেয়া যেতে পারে এবং গাছপালার ফলনের জন্য এটি ব্যবহার করা উত্তম। অনেকেই কফি ছাড়া দিন শুরু করতে পারেন না। কফি বিন দিয়ে বাড়িতেই কফি বানানোর অভ্যাস থাকে অনেকের। সে ক্ষেত্রে কফি তৈরির পর কফি বিনের গুড়ো ফেলে না-দিয়ে, তার সাহায্যে উৎকৃষ্ট মানের সার হিসেবেও ব্যবহার করা যায়। এতে নাইট্রোজেন, ফসফরাস, পটাশিয়াম থাকে, যা গাছপালার বিকাশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কফির গুঁড়ো মশা তাড়ানোর কাজও করে। আবার কফির গুঁড়ো ছড়িয়ে রাখলে, স্ত্রী মশা ডিম পাড়তে পারে না।

অপ্রয়োজনীয় ও কম প্রয়োজনীয় অনুষ্ঠানাদি পরিহার

বৈশ্বিক সংকট তথা টেকসই উন্নয়ন সর্বোপরি পরবর্তী প্রজন্মের কথা চিন্তা করে বিভিন্ন অপ্রয়োজনীয় ও কম প্রয়োজনীয় অনুষ্ঠানাদি যেমন- প্রীতিভোজ, বনভোজন, বার্ষিক ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, কুলখানি, বার্ষিক সাধারণ সভা, ষান্মাসিক সাধারণ সভা, ত্রৈমাসিক সভা, রিইউনিয়ন ইত্যাদি ব্যনারে খাবারের উৎসবে মেতে ওঠা জরুরি ভিত্তিতে বন্ধ করা প্রয়োজন। কেননা এসকল ব্যনার ব্যবহার করে মূলত খাবারের মচ্ছবই নিশ্চিত করা হয়। তবে শারীরিক ও মানসিক বিকাশের স্বার্থে শুধুমাত্র সাংস্কৃতিক ও ক্রীড়া অনুষ্ঠান করা যেতে পারে, তাতে দোষের কিছু নাই। এসব অনুষ্ঠানে খাবারের বাজেট হিসাবে বরাদ্ধ যদি থাকে তবে তা অর্ধাহারে বা অনাহারে যে সকল জনগোষ্ঠী কষ্ট পাচ্ছে তাদের ক্ষুধা নিবৃতিতে ব্যবহার করা যেতে পারে।

বর্ণিত উপায়সমূহ ছাড়াও আরও নানাভাবে খাবারের অপচয় রোধ করা যায়, সবারই উচিৎ যার যার সুযোগ ও সুবিধানুযায়ী টেকসই উন্নয়ন তথা দায়িত্বশীল ভোগ (Responsible Consumption) নিশ্চিতকরণার্থে বাধ্যতামূলকভাবে খাবার ও অন্যান্য পণ্যের অপচয়রোধে সক্রিয় ভূমিকা রাখা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগামীদিনে সারা বিশ্বে খাদ্য সংকট তীব্র হবে। তার কিছু কিছু নমূনা এখনই শ্রীলংকা ও হাইতিসহ বিভ্ন্নি দেশে পরিলক্ষিত হচ্ছে। দিনে দিনে বিশ্বব্যাপী খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা ভয়াবহ হয়ে উঠেছে এবং অনাহারে মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ভি পাচ্ছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে অর্থনীতিবিদ এবং বিশেষজ্ঞরা বলছেন যে, বিশ্বব্যাপী দুর্ভিক্ষ হতে পারে। সামনে হয়ত কঠিন সময় ও মন্দা অপেক্ষা করছে। বৈশ্বিক মন্দার পাশাপাশি, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ফসল উৎপাদনে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব এখনই দৃশ্যমান।

জলবায়ু পরিবর্তন, অতিবৃষ্টি, বৃষ্টিপাতের অভাব, অসময়ে বৃষ্টি, বন্যা, খরা, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে কৃষিজমির লবণাক্ততা বৃদ্ধি, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি, মাটি ক্ষয় ইত্যাদির কারণে কৃষি উৎপাদনও ব্যাহত হচ্ছে। ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা এবং পানির ঘাটতির কারণে এশিয়ার কিছু অংশে খাদ্য নিরাপত্তা মারাত্মকভাবে হুমকির মুখে পড়বে বলে গবেষকগণ আশংকা করছে।

এ অবস্থায় খাদ্যের অপচয় কোনোভাবেই কাম্য নয়। খাবারের অপচয় মানে কোটি কোটি ক্ষুধার্ত মানুষকে খাবার থেকে বঞ্চিত করা। আর ক্ষুধার্তকে বঞ্চিত করা মানবতার বিরুদ্ধে এক ধরনের গর্হিত অপরাধের শামিল। সুতরাং, খাদ্যের অপচয় রোধে আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে। বৈশ্বিক খাদ্য অপচয়ের অভ্যাস রাতারাতি পরিবর্তন করা যাবে না। টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে তথা ক্ষুধামুক্ত বিশ্ব গড়ার প্রত্যয়ে ব্যক্তি পর্যায়েই এ বিষয়ে সচেতনতা প্রয়োজন। যাতে খাদ্যের অপচয় শুন্যের কোটায় নামিয়ে আনা সম্ভব হয়৷ সে সাথে ক্ষুধার্ত কে খাদ্য দান করার চেষ্টা করতে হবে এবং অন্যকেও সচেতন করা জরুরি। অতিরিক্ত খাবার নিয়ে অর্ধেক ডাস্টবিনে না ফেলে ক্ষুধার্থ মানুষগুলোর দিকে মানবতার হাত বাড়িয়ে দেয়া সময়ের দাবি। অনেক শহরেই বহু মানুষ এখনও খাবার না পেয়ে আবর্জনা স্তূপ থেকে মাংসের হাড্ডি চুষে খায়। তাই খাবার অপচয়ে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় না করে বরং তাদের খাবার জোগানে কিছু অর্থ ব্যয় করা জরুরি।

তথ্যসূত্র:

www.armiah.com