চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে শ্রমিকের অধিকার, ট্রেড ইউনিয়ন, আইএলও কনভেনশন
-©মোঃ আবদুর রহমান মিঞা (‘শেখ হাসিনা ইয়ুথ ভলান্টিয়ার অ্যাওয়ার্ড ২০২০’ পদকপ্রাপ্ত, মেন্টাল হেলথ অ্যাম্বাসেডর, রিসার্চ ফেলো-কার্টিন ইউনিভার্সিটি-অষ্ট্রেলিয়া)
ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিলেশন্স এন্ড লেবার স্টাডিজ, মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা, হিউম্যান রাইটস এন্ড সোশ্যাল জাস্টিস, হিউম্যান রাইটস এন্ড সিকিউরিটি স্টাডিজ বিষয়সমূহের একনিষ্ঠ শিক্ষার্থী
করোনা মহামারীতে বাড়ি থেকে কাজ কিংবা রিমোট অফিসের ধারণা বিস্তার লাভ করে এটি এখন সংস্কৃতি হিসাবে বিকাশ লাভ করেছে, যা সকলের নিকট গ্রহণযোগ্যও বটে। চলমান চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে প্রযুক্তিগত অগ্রগতি হেতু অনেক ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের কর্মক্ষেত্র সুনির্দিষ্ট ও সুসজ্জিত অফিস থেকে বাসায় বা ভার্চ্যূয়াল স্থানে স্থানান্তরিত হয়েছে। ফলে বাসা/বাড়ীভিত্তিক এবং ভার্চ্যূয়াল কর্মীদের সংখ্যা দিন দিনই বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এই শ্রমিকদের প্রচলিত অফিসের মতো কোন সুনির্দিষ্ট ও সুসজ্জিত কর্মক্ষেত্র নাই, না তারা শ্রম আইন বা অন্যান্য আইনি ইনস্ট্রুমেন্টের আওতায় পড়ে। বিধায় তারা কীভাবে সংগঠিত হতে পারবে বা কীভাবে ট্রেড ইউনিয়ন গঠণপূর্বক নিয়োগকর্তা বা মালিক পক্ষের নিকট তাদের দাবি-দাওয়া জানানোর লক্ষ্যে সম্মিলিত দর কষাকষি করবে সে বিষয়টি সুস্পষ্ট হওয়া জরুরি বলে প্রতীয়মান হয়। এমন পরিস্থিতিতে অর্থাৎ চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে কর্মক্ষেত্রের বাইরে বিচ্ছিন্নভাবে অবস্থিত শ্রমিকদের সংগঠিত করা এবং তাদের জন্য ট্রেড ইউনিয়ন গঠণপূর্বক দর কষাকষি করা একটা বৃহৎ চ্যালেঞ্জ হতে যাচ্ছে।
বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা, জার্নাল ও গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গেছে বর্তমানে বাংলাদেশে শতকরা আশি ভাগেরও বেশি শ্রমিক এবং তাদের বড় একটা অংশই অবস্থান করছে অনানুষ্ঠানিক ক্ষেত্রে, যাদের শ্রম আইনের আওতাভূক্ত হওয়ার সুযোগও কম। এমনকি তারা ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের যোগ্যও না। এছাড়াও বিদ্যমান শ্রম আইন অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট সংখ্যক শ্রমিক ইউনিয়নে যোগদান না করলে তাদের পক্ষে ট্রেড ইউনিয়ন বা শ্রমিক কল্যাণ সমিতি গঠন করা সম্ভব হবে না। প্রাযূক্তিক অগ্রগতি এবং উদ্ভাবনের কারণে দিন দিনই উন্নত হচ্ছে রোবটিক্স প্রযূক্তি। সে দিন দূরে নয় যখন রোবট হবে মানুষের সহকর্মী। বর্তমানে অনেক প্রতিষ্ঠাণেই ব্যবহার হচ্ছে কোবট (কোলাবোরেটিভ রোবট)। রোবটিক্স প্রযূক্তির উত্তরোত্তর উন্নয়নের কারণে বিদ্যমান কর্মীদের চাকরি হারানো এবং বেতন হ্রাস হতে পারে যদি আমরা এখনই চলমান নব নব উদ্ভাবিত প্রযূক্তির যুগে প্রাযূক্তিক দক্ষতা অর্জনে ব্যর্থ হই। এ দুর্বলতা বিবেচনা করে বিক্ষিপ্ত এবং অসংগঠিত ভবিষ্যতের শ্রমিকদের জন্য ট্রেড ইউনিয়ন বা শ্রমিক কল্যাণ সমিতি গঠন করা আরও কঠিন হয়ে পড়বে তাতে কোন সন্দেহ নাই। এমন পরিস্থিতিতে ও চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রাক্কালে ট্রেড ইউনিয়ন বা শ্রমিক কল্যাণ সমিতির মাধ্যমে যৌথ দরকষাকষি উল্লেখযোগ্য সমূহ চ্যালেঞ্জ তৈরি হওয়া মাত্র সময়ের ব্যাপার।
এমনিতেই ডিজিটাল অটোমেশনের প্রতিযোগিতামূলক কর্মক্ষেত্রে টিকে থাকার জন্য সংগ্রাম করা কর্মীদের জন্য অতিরিক্ত চাপ আনতে পারে, যা কর্মক্ষেত্রে নেতিবাচক আচরণ এবং ক্ষেত্রটিকে অসুস্থ পরিবেশের দিকে ধাবিত করতে পারে। এমন পরিস্থিতি শ্রমিকদের জন্য অতিরিক্ত চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে এবং তাদের ট্রেড ইউনিয়নের প্রতি মনোযোগ দিতে তথা তাদের অধিকার আদায় করা থেকে বিরত রাখতে পারে।
এছাড়াও বাংলাদেশে ট্রেড ইউনিয়ন সংশ্লেষে অদ্যাবধি চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের মাধ্যমে উপনীত প্রাযূক্তিক পরিবর্তনের বিষয়ে সুস্পষ্ট ধারণা বা ক্ষেত্র তৈরি করতে পারে নাই বলেই প্রতীয়মান হয়। বিদ্যমান ইউনিয়ন বা সমিতিগুলোও এখন পর্যন্ত চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ এবং সুযোগ গ্রহণের জন্য নিজেদেরকে দৃশ্যমান কোন প্রস্তুত করতে সক্ষম হয় নাই।
এমন পরিস্থিতির সাথে নিজেদেরকে এবং অন্যদেরকে খাপ খাইয়ে নেয়ার জন্য প্রয়োজন প্রশিক্ষণ, কগনিটিভ লার্নিং, গবেষণা, পাণ্ডিত্যপূর্ণ প্রচেষ্টা, নলেজ শেয়ারিং, জীবনব্যাপী শিক্ষা এবং সর্বোপরি একটি কৌশলগত পরিকল্পনা ও তার যথাযথ বাস্তবায়ন।
পাশাপাশি চতুর্থ শিল্পবিপ্লবহেতু উদ্ভূত চ্যালেঞ্জসমূহ মোকাবেলার জন্য প্রয়োজন বিদ্যমান শ্রম আইনগুলির সময় ও যুগোপযোগী সংস্কার, যা সময়ের দাবী কেননা অগ্রগতির সাথে তাল মিলিয়ে চলার জন্যও কর্মক্ষেত্রে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের গুরুত্ব অপরিসীম। এছাড়াও বিদ্যমান পরিস্থিতিতে শ্রমিকদের অধিকার রক্ষায় ট্রেড ইউনিয়নগুলোকেও নিজেদের পথ ও পন্থা উভয়টিই খুঁজে নিতে হবে। ট্রেড ইউনিয়নগুলিকে অবশ্যই দর কষাকষির গতানুগতিক কৌশলসমূহ থেকে দূরে সরে আসতে হবে এবং যুগের সাথে তাল মিলিয়ে নতুন প্রযূক্তি নির্ভর কাজের ধরণ ও প্রকৃতির সাথে খাপ খাইয়ে শোভন কৌশল প্রয়োগের ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে, নিশ্চিত করতে হবে আইএলও কনভেনশন ৮৭ ও ৯৮।
গ্রন্থপঞ্জি
– রহমান মিঞা, মোঃ আবদুর, “চতুর্থ শিল্পবিপ্লব: প্রস্তুতির এখনই সময়”, মৃত্তিকা প্রকাশন, ঢাকা, ডিসেম্বর ২০২১.